ছয় মাসে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে অস্বাভাবিক ট্রেন্ড শনাক্ত করেছে, তা দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার সামনে এক নতুন মাত্রার ছায়াযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নৃশংস জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলোর একটি পাকিস্তানের করাচি থেকে পরিচালিত টিটিপি এবার তাদের রিক্রুটমেন্ট চ্যানেলে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে। আর সেই কাজটি করছে বাংলাদেশেরই এক বিতর্কিত ব্যক্তি ইমরান হায়দার, যার অতীত ও বর্তমান- উভয়ই নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে এখন বড় প্রশ্ন।
পাকিস্তানভিত্তিক রিক্রুটমেন্ট নেটওয়ার্ক : বাংলাদেশের তরুণদের টেনে নেয়া হচ্ছে ছায়াযুদ্ধে
সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে- গত কয়েক মাসে ইমরান হায়দারের মাধ্যমে ৩০ জনের বেশি বাংলাদেশী পাকিস্তানে পৌঁছেছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। এই তথ্য বাংলাদেশের নিরাপত্তা মহলে তীব্র আলোড়ন তুলেছে।
আরো চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো- ইমরান হায়দার কোনো প্রচলিত উগ্রপন্থী ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বড় হননি। তিনি সাভার এলাকার একজন ব্যক্তি, যার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। ছাত্রলীগে সক্রিয়তা ছিলেন, পাশাপাশি ভারত মদদপুষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী, ছায়ানট ও ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াত ছিল- এমন তথ্য গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে।
প্রশ্ন হলো- একজন ছাত্রলীগ-ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী কিভাবে পাকিস্তানভিত্তিক টিটিপির জন্য রিক্রুটার হয়ে উঠলেন? আরো গুরুত্বপূর্ণ- ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারত যে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের ফ্রেমে ঠেলতে চেষ্টা করেছে, সেই প্রেক্ষাপটে এই রিক্রুটমেন্ট কার স্বার্থে?
সামাজিক মাধ্যমে হাইপার-অ্যাকটিভ রিক্রুটমেন্ট : বাংলাদেশকে ‘টেররিজম হাব’ বানানোর ছক?
ইমরান হায়দার শুধু একজন ব্যতিক্রমী রিক্রুটার নন, তিনি পরিচালনা করছেন একটি ডিজিটাল রিক্রুটমেন্ট আর্কিটেকচার। তার প্ল্যাটফর্মগুলোতে রোহিঙ্গা, পাকিস্তান, টিটিপি, মুসলিম নিপীড়ন, ভারত বিরোধী আবেগ- সবকিছু মিলিয়ে এমন কনট্যান্ট স্ট্র্যাটেজি দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ডিজাইন করা অপারেশনে দেখা যায়। নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, এই নেটওয়ার্কের স্টাইল, কনট্যান্ট ও রিচ দেখে স্পষ্ট- কেউ একজন তাকে ব্যবহার করছে।
ভারত-পাকিস্তান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশকে ‘টেররিজম থ্রেট জোন’ হিসেবে তুলে ধরার অপারেশন বহু দিন ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলছে। ইমরান হায়দারের নেটওয়ার্ক সেই ন্যারেটিভকেই নতুন জ্বালানি জোগাতে পারে। এটি সফল হলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে, আন্তর্জাতিক ফোরামে সন্ত্রাস-ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দেয়ার সুযোগ মিলবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর কঠোর অবস্থান নিতে পারে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটকে নতুনভাবে ফ্রেম করা : টিটিপি-আরসা সংযোগের ভয়াবহ অভিঘাত : রোহিঙ্গা সঙ্কট বড় একটি মানবিক ইস্যু। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেটিকে সচেতনভাবে একটি সিকিউরিটি ন্যারেটিভে পরিণত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আর সেই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো টিটিপি-আরসা সংযোগ।
আরসা যে গোষ্ঠী নিজেদেরই ১,১০০-এর বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে তাদের কিছু শক্তি ‘রোহিঙ্গা প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন’ বানানোর চেষ্টা করছে। যদি এটি সফল হয় তাহলে মিয়ানমার সহজেই ভবিষ্যতের গণহত্যাকে ‘কাউন্টার-টেরর অপারেশন’ হিসেবে বৈধতা দিতে পারবে।
২০১৬-১৭ সালে আরসার সীমান্তপোস্ট হামলার অজুহাতে মিয়ানমার যেভাবে জেনোসাইড চালায়, সেই মডেল আবার ফিরে আসতে পারে, কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসহ।
রোহিঙ্গা নেতৃত্ব হত্যা থেকে ডিজিএফআই কর্মকর্তা হত্যা : আরসার দুঃসাহস বাড়িয়েছে কে?
আরসার সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যা, আলেম মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ হত্যা এবং ডিজিএফআই কর্মকর্তা রিজওয়ান রুশদীকে কক্সবাজারে নির্মমভাবে হত্যা- সবখানেই আরসার হাত ছিল।
তদন্তে আরো উঠে আসে- আরসা প্রধান আতা উল্লাহ পাকিস্তানভিত্তিক আইএস- ঘনিষ্ঠ জামায়াতুল আহরারের সদস্য ছিলেন। অর্থাৎ আরসাকে ব্যবহার করে যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে তা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
ইমরান হায়দারের ভিডিও : সময়টা কি কাকতালীয়?
সাম্প্রতিক একটি ভিডিওতে দেখা যায়- ইমরান হায়দারের বাসায় তিন বাংলাদেশী তরুণ এসে আরসার পক্ষে বার্তা দিচ্ছে, বাংলাদেশী আলেমদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভাষণ দিচ্ছে। ভিডিওটি নির্বাচন-পূর্ব মুহূর্তে প্রকাশিত হওয়ায় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এটিকে অত্যন্ত কৌশলগত সময় হিসেবে দেখছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা- পার্শ্ববর্তী একটি রাষ্ট্র এই ভিডিওর সময়, টোন ও কনট্যান্ট নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। এর উদ্দেশ্য : ১. রোহিঙ্গা ইস্যুকে সিকিউরিটি ফ্রেমে নেয়া, ২. বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে এক্সট্রিমিজম-হাইলাইটেড দেশে পরিণত করা এবং ৩. আরসা-টিটিপিকে একই ক্যাটাগরিতে তুলে ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ বৈধ করা।
দুই মুখী রিক্রুটমেন্ট : বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় অ্যালার্ম
এখন দুই স্থানে রিক্রুট হচ্ছে : বাংলাদেশের ভেতর থেকে টিটিপির প্রতি সহানুভূতিশীল তরুণ আর করাচির বার্মা কলোনি থেকে রোহিঙ্গা তরুণদের টিটিপিতে যুক্ত করা হচ্ছে।
এই দুই ফ্লো একসাথে মিললে একটি অত্যন্ত জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে, যা কোনো একক জঙ্গি সংগঠনের পক্ষে পরিচালনা করা অসম্ভব। এটি ইঙ্গিত করে- কিছু রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে এই ফ্রেমকে ব্যবহার করছে।
এর উদ্দেশ্য হতে পারে- আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়া, রোহিঙ্গা ইস্যুকে মানবিক থেকে নিরাপত্তা ইস্যুতে সরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক প্রক্সি সঙ্ঘাতে জড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা।
আরাকান আর্মির বৈধতা- বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ নিরাপত্তা ঝুঁকি
যদি আন্তর্জাতিকভাবে আরাকান আর্মিকে ‘অ্যান্টি-টেরর’ গোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরা হয় তাহলে সবচেয়ে বড় আঘাত আসবে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
সূত্র বলছে, প্রায় ৫,০০০ মারমা, মগ, চাক, বম, ম্রো তরুণ আরাকান আর্মিতে যোগ দিয়েছে। আরাকান আর্মিকে বৈধতা দেয়া মানে- তাদের অর্থায়ন বাড়বে, অস্ত্র আসবে, সশস্ত্র কর্মপরিসর বেড়ে যাবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট হয়ে উঠবে।
এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য অস্তিত্বগত ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের সামনে উদীয়মান নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতা : এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা তিন অক্ষে চাপের মুখে- ১. ডিজিটাল রিক্রুটমেন্ট নেটওয়ার্ক, ২. রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক সিকিউরিটি ন্যারেটিভ এবং ৩. পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রক্সি জোন বানানোর চেষ্টায় আঞ্চলিক শক্তি।
এটি একটি স্পষ্ট হাইব্রিড থ্রেট আর্কিটেকচার, যেখানে সন্ত্রাসবাদ, গোয়েন্দা অপারেশন, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, মানবিক সঙ্কট এবং ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা- এক জায়গায় এসে মিশেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য জরুরি কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত. ইমরান হায়দারসহ ডিজিটাল রিক্রুটমেন্ট নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-রোহিঙ্গা ট্রায়াঙ্গল দিয়ে যে রিক্রুটমেন্ট চলছে তা অবিলম্বে আইনি ও প্রযুক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত. রোহিঙ্গা সঙ্কটকে মানবিক অবস্থায় রাখা, এটিকে সিকিউরিটি ফ্রেমে যেতে দেয়া যাবে না। এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সুরক্ষা। তৃতীয়ত. আরাকান আর্মিকে আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে দেয়া যাবে না। এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য আত্মঘাতী হবে। চতুর্থত. রোহিঙ্গা নেতৃত্ব হত্যার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা, যাতে হত্যকারীরা এ ধরনের কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে। পঞ্চমত. মূলধারার আলেম সমাজকে সাথে রাখা- উগ্রপন্থা প্রতিরোধে এটি কার্যকর ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে।
ভবিষ্যতের ঝুঁকি : যদি ন্যারেটিভ সফল হয়
বিশ্লেষকদের মতে আগামী দিনে কয়েকটি কঠিন বাস্তবতা দেখা দিতে পারে- বাংলাদেশকে সন্ত্রাস-ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে ব্র্যান্ড করার অপচেষ্টা হতে পারে। রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রায় স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নতুন আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এই সব কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিটিপি-আরসা সংযোগ ও ইমরান হায়দার নেটওয়ার্কের মুখোশ দ্রুত উন্মোচন করা এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অনিবার্য দায়িত্ব।



