২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও স্পষ্ট মেরুকরণ শুরু হয়েছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি- এই তিনটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন অবস্থান স্পষ্ট করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা সংস্কার প্রক্রিয়া এখন প্রবেশ করেছে নির্বাচনী রূপান্তরের পর্যায়ে। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনো অধরা বলে মনে হলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচন নিয়ে এজেন্ডা ঠিক করা ও আসন সমঝোতাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, ‘জুলাই সনদের যে অংশে আমরা সই করেছি, তার দায়দায়িত্ব আমরা নেবো; কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি, সেটার দায় আমাদের নয়।’
অন্য দিকে এই মন্তব্য বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত বহন করলেও হাইকমান্ডের সূত্র বলছে, মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডিসেম্বরের শুরুতে দেশে ফিরবেন। অন্য দিকে, জামায়াতসহ ৮ দল সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটসহ ৫ দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। জামায়াত সমমনা দলগুলো দুটি বিষয়ের ওপর ফোকাস করতে চাইছে একটি হলো- জুলাই বিপ্লবের পর টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য গৃহীত জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট আর দ্বিতীয়টি হলো মুক্ত অবাধ ও সমতল নির্বাচনী পরিবেশ যেখানে জনগণ বাধাহীনভাবে তাদের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন।
এ দিকে শেখ হাসিনা তিনটি গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষৎকারে তার দল আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বয়কট করবে বলে ঘোষণা করেছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার ও দলের বিচারের যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে ক্ষমতাচ্যুত দলটির চাইলেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা নেই।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে ৩ শিবিরে মেরুকরণ : ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারো তীব্রভাবে মেরুকরণ হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পার করে এখন নির্বাচনী রূপরেখা চূড়ান্ত করার পথে। এ প্রক্রিয়ায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করছে এবং তাতে স্পষ্টভাবে তিনটি ধারা তৈরি হয়েছে। এই ধারাগুলো হলো- বিএনপি-মধ্যপন্থী উদার গণতান্ত্রিক ঐক্য শিবির, জামায়াত-কেন্দ্রিক ইসলামী ও মধ্যপন্থী সমমনা জোট এবং এনসিপি-কেন্দ্রিক নাগরিক পুনর্গঠন জোট।
বিএনপি-কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ঐক্য শিবির : বিএনপি এখনো দেশের বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দলটি ঘোষণা করেছে যে তারা ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর যে অংশে স্বাক্ষর করেছে, সেটি বাস্তবায়নের দায় নেবে, তবে অন্য কোনো অংশ বাস্তবায়নে তারা বাধ্য থাকবে না। তাদের মূল লক্ষ্য হলো- নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ।
দলটি এখন নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন এবং কিছু আঞ্চলিক দলের সাথে আলোচনায় আছে একটি ‘গণতান্ত্রিক ঐক্য ফ্রন্ট’ গঠনের বিষয়ে। দুয়েকটি ইসলামী দলকেও তারা জোট সঙ্গী করতে পারে।
জামায়াত-কেন্দ্রিক ইসলামী ও মধ্যপন্থী সমমনা জোট : জামায়াতে ইসলামী জুলাই আন্দোলনের সময় জোরালোভাবে মাঠে থাকার পাশাপাশি এখন নতুনভাবে রাজনীতির পরিসরে জায়গা করে নিয়েছে। দলটির নেতৃত্বাধীন একটি “ইসলামী মঞ্চ ও মধ্যপন্থী সমমনা ঐক্যজোট পুনর্গঠনের উদ্যোগ চলছে। এতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্তত ৮টি দল এর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দিচ্ছে। আজ দলগুলো রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণার ব্যাপারে বসবে এবং সংবাদ সম্মেলনে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করবে। এই ৮টি দলের বাইরে আরো দল এ জোটের সাথে যুক্ত হতে পারে। তাদের কৌশল হলো: ‘ধর্মীয় ভোটব্যাংককে একত্র করা এবং মধ্যপন্থী দলগুলোকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া।
এনসিপি-কেন্দ্রিক নাগরিক জোট : জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিএনপি ও জামায়াত উভয় পক্ষের সাথে সমঝোতার ব্যাপারে যোগাযোগ বজায় রাখছে বলে খবর বের হলেও জুলাই সনদে এখনো স্বাক্ষর না করা দলটি নিজেকে ‘তৃতীয় বিকল্প শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এনসিপি নেতৃত্ব বলছে, তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি নাগরিকভিত্তিক জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
এর সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে আমার বাংলাদেশ পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের নাম আসছে। তারা জোটটিকে মধ্যপন্থী নাগরিক প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে। তাদের নির্বাচনী রূপরেখা হলো- রাষ্ট্র পুনর্গঠনে নাগরিক অংশগ্রহণ, দুর্নীতি দমন ও স্বচ্ছ আর্থিক প্রশাসন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপির অবস্থান বিএনপি ও জামায়াত উভয়ের বিকল্প হিসেবে ‘মধ্যপন্থী রিফর্মিস্ট’ শক্তি হয়ে উঠতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তরুণদের দল হিসাবে এনসিপি গঠিত হলেও দেশের শীর্ষ চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচনে তারা মোটেই ভালো করতে পারেনি। তারা নাগরিক সমাজকে কতটা সংগঠিত করতে পারবে তা নিয়েও কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না।
জুলাই জাতীয় সনদের অন্যতম দাবিকারী জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করবে সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর। দলের নেতারা বলছেন- সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে ভোট অর্থবহ হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ : ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে দুটি বড় চাপের মুখে- এক দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী অবস্থান স্পষ্ট না হওয়া, অন্য দিকে প্রশাসনিক কাঠামো ও নির্বাচনী আইনি সংস্কার সম্পূর্ণ না হওয়া।
সরকারের একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা চাই একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন, কিন্তু অনেক দল এখনো প্রার্থী নির্ধারণ বা প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার বিষয়ে নিশ্চুপ। এ দিকে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করেছে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যদিও চূড়ান্ত তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি। ইসি সূত্রে জানা গেছে, ৩০০ আসনের জন্য ভোটকেন্দ্র চিহ্নিতকরণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজ প্রায় শেষ। বিদেশী পর্যবেক্ষক আমন্ত্রণ এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়ছে : রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতি দিনই দলীয় সভা, মিছিল ও পোস্টার-প্রচারণা বাড়ছে। বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগ ও সমাবেশ করছেন, অন্য দিকে জামায়াত প্রার্থীরাও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন জুলাই-পরবর্তী সংস্কার ও টেকসই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দ্বিমাত্রিক- এক দিকে সংস্কারবাদী শক্তি, অন্য দিকে পুরনো ক্ষমতাকাঠামোর দলগুলো। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এই দুই শক্তির সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়াবে।
ভবিষ্যৎ দৃশ্যপট : রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের- ট্রানজিশন পলিটিক্স’-এর প্রথম বড় পরীক্ষা। এই নির্বাচন শুধু একটি সরকার নির্বাচনের নয়, বরং জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী শাসনব্যবস্থার বৈধতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া হিসেবেও বিবেচিত হবে। যদি সব দল অংশ নেয়, তবে এটি হতে পারে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার সূচনা। কিন্তু একতরফা নির্বাচন হলে আবারো অস্থিরতা ফিরে আসার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে- এক দিকে স্থিতিশীল সংস্কার প্রক্রিয়া, অন্য দিকে নির্বাচন নিয়ে পতিত শক্তির বৈরী তৎপরতা। ফেব্রুয়ারির ভোট শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা ঠিক করবে।



