জুলাই বিপ্লব শুধু হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের জন্যই নয়!

এ বিপ্লবের পেছনে রয়েছে সব মজলুম মানুষের আত্মত্যাগ। ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পেতেই আন্দোলন করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ছাত্র, সিপাহী, ঈমানদার দেশপ্রেমিক জনতা।

Printed Edition
জুলাই বিপ্লব শুধু হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের জন্যই নয়!
জুলাই বিপ্লব শুধু হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের জন্যই নয়!

ড. ফয়জুল হক

জুলাই বিপ্লব একটি শুধুমাত্র শেখ হাসিনার বিদায় ঘণ্টা বাজানোর জন্যই হয়নি, বরং ১৬ বছরের সব জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক গণ-অভ্যুত্থান। এ বিপ্লবের পেছনে রয়েছে সব মজলুম মানুষের আত্মত্যাগ। ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পেতেই আন্দোলন করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ছাত্র, সিপাহী, ঈমানদার দেশপ্রেমিক জনতা।

একটু যদি আমরা চিন্তা করে দেখি, ঠিক কী কারণে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেতে হলো? কী কারণে হাসিনার পালানোর পর সবচেয়ে মন খারাপ করে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করল কোনো দেশ? হাসিনার পালানো এবং ভারতের মন খারাপের মধ্যেই পেয়ে যাবেন ‘জুলাই বিপ্লব’-এর নেপথ্যের ইতিহাস। কারণ এই দু’টি গোষ্ঠীই ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে শোষণ করেছে, নির্যাতন করেছে, জনমানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে।

জুলাই বিপ্লব সংঘটনের দশটি কারণ

১. ইসলামী নেতাদের পরিকল্পিত হত্যা ও শাহবাগ নাটক : ২০১৩ সালে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে শাহবাগ আন্দোলন সাজিয়ে একটি ইসলামিক দলকে টার্গেট করে তাদের শীর্ষ নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম, নিজামী, সাঈদী, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামানসহ বহু নেতাকে ফাঁসি ও জেলের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। যা এই সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ পর্যন্ত প্রকাশ করতে দেয়নি হাসিনা সরকার।

  • সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ছাত্র-জনতাকে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। দাড়ি থাকলেই, নামাজ পড়লেই তাকে রাজাকার-আলবদর তকমা দিয়ে জঙ্গি বানিয়ে দেয়া হতো। যা মানুষ সহ্য করতে পারেনি। একসময় এসব অপশাসনের বিরুদ্ধেই জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিজয় অর্জন করে ৩৬ জুলাই ২০২৪ সালে।

২. আলেম-ওলামার ওপর নির্যাতন ও শাপলা চত্বর গণহত্যা : বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও হকপন্থী পীর-মাশায়েখদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে সত্যকে দমন করতে চেয়েছে হাসিনা সরকার। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বন্ধ করতে শত শত মানুষকে হত্যার অভিযোগ ওঠে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সেই সময় আলেমগণ ছিলেন নিরস্ত্র ও অসহায়। রাতের অন্ধকারে শাপলা চত্বর দখল করে আলেমদের কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। পরে অনেককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে, জামিন না দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এসব কারণেই বাংলাদেশ ‘জুলাই বিপ্লব’-এর পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে।

৩. সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার জন্য ৫৭ অফিসার হত্যা : দেশপ্রেমিক ৫৭ জন সেনাবাহিনীর সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শেখ হাসিনার পরিকল্পনায়। এটি সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার ভারতের একটি কৌশল ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ভারত ও হাসিনা। মূলত এই হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে কব্জায় আনতে চেয়েছিলেন তিনি। এসব অপরাধই ‘জুলাই বিপ্লব’-এর জন্য জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তোলে।

৪. বেগম খালেদা জিয়ার অন্যায় কারাবাস : সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী করে রাখা হয়। তাকে চিকিৎসা নিতে পর্যন্ত দেয়া হয়নি, যা জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যারা ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন, তাদেরকেও হয়রানি, অপদস্থ ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। পদ্মাসেতু থেকে ফেলে দেয়া, অকারণে গ্রেফতার, নির্যাতন- এসবই একদিন বিস্ফোরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

৫. ভোটারবিহীন নির্বাচন ও ভোটাধিকার হরণ : বারবার ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখলে রাখেন। ২০১৪ সালে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন। ২০১৮ সালে ‘রাতের ভোট’-এর মাধ্যমে পুরো নির্বাচন প্রহসনে পরিণত করেন। ২০২৪ সালে ‘ডামি প্রার্থী’ দিয়ে নির্বাচনের নাটক করে নিজেকে ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। জনগণ এসব নির্বাচনকে কখনোই গ্রহণ করেনি। জনগণ ভোটের অধিকার ফিরে পেতেই ‘জুলাই বিপ্লবে’ অংশগ্রহণ করে।

৬. বাকস্বাধীনতা হরণ ও মত প্রকাশের অধিকার দমন:

  • বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনে মানুষ কখনোই হাসিনাবন্দনা ছাড়া টিকে থাকতে পারেনি। যারা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে চেয়েছে, তাদের দেশছাড়া হতে হয়েছে। অনেকেই এখনো প্রবাসে নির্বাসিত। বাধ্য হয়েই দেশপ্রেমিকরা বিদেশ থেকে আন্দোলন পরিচালনা করে গেছেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ‘জুলাই বিপ্লব’-এর প্রেক্ষাপট।

৭. গুম, খুন ও ‘আয়না ঘরে’ নির্যাতন : মতের ভিন্নতার কারণে মানুষকে গুম, হত্যা, নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। কত শত ‘ক্রসফায়ার’ ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। ‘আয়না ঘর’ নামক নির্মম নির্যাতন কক্ষ তৈরি করে চালানো হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, আলেম, কেউ রক্ষা পাননি। বাধ্য হয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘জুলাই বিপ্লব’-এ।

৮. কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর দমননীতি : ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পরে ২০২৪ সালের আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় ট্যাগিং রাজনীতি। তাদের বলা হয় ‘রাজাকার-পুত্র’, ‘জঙ্গি’, ‘আলবদর’। এসব দমননীতি ছাত্রদের হৃদয়ে ক্ষোভ জমিয়ে তোলে, যা পরিণত হয় গণ-আন্দোলনে।

৯. আবরার ফাহাদ হত্যা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা : বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন বলেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তাকে পানি খেতে দেয়া হয়নি, মায়ের সাথে শেষ কথা বলতে দেয়া হয়নি। এই নির্মমতা দেশের ছাত্র-জনতাকে রাস্তায় নামিয়ে আনে।

১০. ২০২৪ সালের ছাত্র-আন্দোলনে গণহত্যা ও পঙ্গুত্ব :

  • ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে হাসিনার সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে রাতের অন্ধকারে গণহত্যা চালায়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে শিশুদেরও হত্যা করা হয়। পরিকল্পিতভাবে দুই হাজারের বেশি মানুষ হত্যা এবং অর্ধলক্ষ ছাত্র-জনতাকে পঙ্গু করা হয়। এই নির্মমতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী সবাই জনতার পক্ষে দাঁড়ায়। ফলে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনাকে গণভবন থেকে পালিয়ে যেতে হয়।

উপসংহার : হাসিনার এই বিদায় ঘণ্টা বাজাতে ছাত্রদের পাশাপাশি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন বিদেশে অবস্থানরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। যারা তাদের টাকা বাংলাদেশে পাঠানো বন্ধ করে দেন। দেশ-বিদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ হাসিনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন এবং তাকে বিতাড়িত করেন।

এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই বিজয়কে ধরে রাখা। যুগের পর যুগ মানুষের মধ্যে এই ‘জুলাই’-এর সঠিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা। লেখনী, পুস্তক, গবেষণা, আলোচনায় থাকতে হবে ৩৬ জুলাইয়ের ইতিহাস।

আমাদের আবারো সেই দিনের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে হবে দেশ গঠনের জন্য। হাসিনার শেখানো ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘ট্যাগিং’-এর রাজনীতি মুছে ফেলতে হবে এখনই। এই দেশে আর কাউকে ‘রাজাকার রাজাকার’ বলে রাজনীতি করার দিন বন্ধ করে দিতে হবে। স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দিতে এখনই সবাইকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পথ চলতে হবে।

সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সুন্দর দেশ গঠনে এগিয়ে যেতে হবে।

জুলাই ঘোষণাপত্র, বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, এবং সত্যিকার নিরপেক্ষ নির্বাচন- এই চারটি বিষয় বাস্তবায়ন করাই এখন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।