আ’লীগের মন্ত্রীর সুপারিশে চাকরি জাল সনদে নিয়েছেন পদোন্নতি

পরিচয় গোপন করে অবৈধ সুবিধা আদায়ের অভিযোগ

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

নিজের দু’টি সার্টিফিকেটই জাল। চাকরির লিখিত পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। শুধু আওয়ামী লীগের এক প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশেই মিলেছে সচিবালয়ের একটি দফতরে চাকরি। পদ সাঁট মুদ্রাক্ষরিক। অবশ্য জাল সার্টিফিকেট দিয়েই ইতোমধ্যে বাগিয়ে নিয়েছেন পদোন্নতিও। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৭ সালের চাকরিতে যোগদান করেই নানাভাবে তদবির আর সুপারিশের বাণিজ্য শুরু করেন। পরিচয় গোপন করে গত সাত বছরে নামে-বেনামে গড়েছেন বিশাল সম্পদের পাহাড়।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, সোহেল মিয়া নামে এই সাঁট মুদ্রাক্ষরিক ২০১৭ সালে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের পরিবারের সদস্যদের তদবিরে সোহেল মিয়া চাকরির লিখিত পরীক্ষায় পাস না করেও মেরিট লিস্টে তার নাম রাখা হয়। এভাবে শুরুতেই নিয়ম ভঙ্গ করে সোহেলের চাকরি শুরু হয় সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে। ওই পদের যোগ্যতা হিসেবে সাঁটলিপি ও কম্পিউটারের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ও সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ সোহেল মিয়ার সাঁটলিপি সনদ এবং কম্পিউটারের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সনদ দু’টিই ছিল জাল।

জাল সনদের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা জানান, স্কিল পারফরম্যান্স-সংক্রান্ত ‘ডিপ্লোমা ইন মাল্টিলিসুয়াল সেক্রেটারিয়াল সাইন্স’ সনদটি বগুড়ায় অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব আইসিটি আন্ডার সিট (ঝওঞ) ফাউন্ডেশন থেকে নেয়া হয়েছে। বগুড়ার এই সিট ফাউন্ডেশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রিবুকে এই নামের সার্টিফিকেটের কোনো অস্তিত্বই নেই। যদিও ‘ডিপ্লোমা ইন মাল্টিলিসুয়াল সেক্রেটারিয়াল সাইন্স’ সনদটির সিরিয়াল নম্বর হলো ঝওঞ-ঐছ-উঝ-৫১৬ তারিখ : ১০/০৭/২০১৬। অথচ ওই সিরিয়াল ও তারিখে প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রিবুকে মোসা: আনজুয়ারা খাতুন নামে অন্য একজন নারী শিক্ষার্থীর নাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জানান, ২০১৬ সালে নেয়া এই সার্টিফিকেটগুলো সম্পূর্ণ হাতে লেখা ছিল; কিন্তু এটার তারিখের ঘরে স্ট্যাম্প সিল দেখে এটার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। সোহেলের আরেকটি ব্যবহারিক সার্টিফিকেট হলো ‘কম্পিউটার অফিস এপ্লিকেশন’ যেটা সংগ্রহ করা হয়েছে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গাতে অবস্থিত দৃষ্টি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে। ওই সার্টিফিকেটটি অনলাইনে পাওয়া গেলেও অফিস রেজিস্টার বুকে এই সার্টিফিকেট/সোহেল মিয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, সোহেল মিয়ার প্রথম পোস্টিং (প্রশাসন শাখা-৫, বর্তমান প্রশাসন শাখা-১)। কয়েক মাস পরে তিনি তৎকালীন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এপিএসের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা লেনদেন করে মন্ত্রীর দফতরে পোস্টিং নেন। এরপর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সোহেল মিয়া। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন শরীফ আহমেদ। আর সোহেল মিয়া নিজেকে আরো প্রভাবশালী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের ছত্রছায়ায় সে টেন্ডার-বাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য, প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাণিজ্যসহ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে কম্পিউটার অপারেটর হওয়ার পরও সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে চলতি দায়িত্বও বাগিয়ে নেয় সোহেল মিয়া।

অভিযোগ রয়েছে- মন্ত্রণালয়ের অনেক সিনিয়র ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এমনকি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) থেকে সরাসরি সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা থাকার পরও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের প্রভাব খাটিয়ে কম্পিউটার অপারেটর হওয়ার পরও সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার পদটি বাগিয়ে নেয়। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, প্রতিমন্ত্রীর দফতর এবং সচিবের দফতর এই দুই দফতরেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকায় সরকারি আবাসন পরিদফতরের বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি বাসা বরাদ্দের ক্ষেত্রে সোহেল মিয়ার ছিল একক আধিপত্য।

অভিযোগ রয়েছে- সোহেল মিয়া ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে মিরপুর ১৬ নং সেকশনের ১৩৫৮ বর্গফুটের ২-১/ সি নম্বর ফ্ল্যাটটি সংরক্ষিত প্রতিমন্ত্রী কোটায় তার বাবা মো: ফজলুল হকের নামে বাগিয়ে নেয়। আবার গত ১৫-১০-২০২৫ তারিখে সোহেলের বাবার নামে ১৫০০ সিসির জাপানি টয়োটা ব্র্যান্ডের সাদা প্রাইভেট কার ক্রয় করে নিজের বাক্তিগত চলাফেরা জন্য যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-২৯-১৩৬৫।

সোহেল মিয়া ২০১৮ সালে চাকরি পাওয়ার পর মাত্র এক বছরের মাথায় কালিহাতী পৌরসভা থেকে ২৯/৯/২০১৯ তারিখে মেসার্স নেক্সাস এন্টারপ্রাইজ নামে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারের ট্রেড লাইসেন্স নেন যার প্রোপাইটার তার বাবা ফজলুল হক। তার ট্রেড লাইসেন্স নাম্বার ০০৭৫১, লাইসেন্স আইডি ০৫-০০৫-০০৭৫১। সোহেলের বাবা ফজলুল হকের টিন নম্বর ৮৫২৮৫২৬২১৪৮৫, মেসার্স নেক্সাস এন্টারপ্রাইজের বিন নাম্বার ০০২২৩৪৯০৪-০৪০৬। কালিহাতির একটি বেসরকারি ব্যাংকে নেক্সাস এন্টারপ্রাইজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, যার অ্যাকাউন্ট নাম্বার ৪০৬০১১১০০০০০২৬৮। যেই অ্যাকাউন্টে ১৬-২-২০২০ তারিখে সর্বশেষ ব্যালেন্স পাওয়া যায় ১০ লাখ ঊনপঞ্চাশ হাজার পাঁচশত চব্বিশ টাকা। এক বিশেষ অনুসন্ধনে জানা যায়, পূর্বে কোন ঠিকাদারি কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকার পরও গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মেসার্স নেক্সাস এন্টারপ্রাইজকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

অবশ্য এসব অভিযোগের বিষয়ে সোহেল মিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, একটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেই এসব মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমারতো এই ছোট পদে চাকরি করারই কথা ছিল না। মিরপুরের ফ্ল্যাটের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমার না। আমি জানিও না। ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার নিজের নামে কোনো লাইসেন্স আছে কি না তথ্য যাচাই করে দেখবেন। সবই অপপ্রচার। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব তথ্য তো আপনার জানার কথা নয়। আমার মনে হয় কেউ আপনাদের (সাংবাদিকদের) ভুল তথ্য দিয়ে মিসগাইড করছে।