ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছোট পরিসরে হলেও পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ভোটিং ও প্রক্সি ভোটিংয়ের যেকোনো একটি পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটিং সিস্টেমের আওতায় প্রথমবারের মতো আনতে চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। এ বিষয়ে এক সেমিনারে তিনি বলেন, দলগুলোর সমর্থন না পেলে ইসির সব ধরনের উদ্যোগ বিফলে পর্যবসিত হবে। আর এতে রাজনৈতিক নেতারা বলেন, আমরা আমাদের দলে আলোচনা করে মতামত দেবো। কোনটা সবচেয়ে ভালো হয় সে মতামত দেবো। সময় নিয়ে তাড়াহুড়া না করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। বিএনপি বলেছে, শুধু এনআইডি বিবেচনায় নিয়ে ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করলে হবে না। এখানে পাসপোর্টকে যুক্ত করতে হবে। কারণ অনেকের এনআইডি নাই। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী বলেছে, প্রক্সি ভোটের যদি অপব্যবহার হয় তাতে ভোটের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রাজধানীর আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে প্রবাসীদের ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে গতকাল অংশীজনের সাথে আয়োজিত সেমিনারে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এসব মতামত দেয়া হয়।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সিইসিও তার মতামত দেন। অনুষ্ঠানে তিনটি পদ্ধতির ওপর ডিজিটাল উপস্থাপনা করা হয়। অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এলডিপি, সিপিবি, জেএসডি, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, এনপিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ জাসদ, এবি পার্টি, গণ-অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিসহ ২১টি দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, জামায়াতে ইসলামীর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মো: মতিউর রহমান আকন্দসহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া সুশীলসমাজের ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।
সভায় প্রবাসীদের ভোট পদ্ধতি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আবুল ফজল মো: সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে প্রবাসী ভোটাররা কোনোদিনই ভোট দিতে পারেননি। প্রবাসী ভোটাররা আমাদের মোট ভোটারের ১০ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য প্রবাসী ভোটারদের ভোটিং সিস্টেমে আনা।
সিইসি যা বললেন : প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, লাগসই একটা অপশন আমরা চালু করতে চাই। আপনাদের সমর্থন চাই। ছোট পরিসরে হলেও যাত্রা শুরু করতে চাই। রাজনৈতিক নেতারা যদি সমর্থন না দেন আমাদের যত এক্সারসাইজ আছে ইট উইং অল অ্যান্ড ইন ফিউটিলি। তিনি বলেন, আজ আমাদের জন্য স্মরণীয় দিন। ইসির এ আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ায় সম্মনিত বোধ করছি। আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের সব ধরনের কাজে আপনাদের সমর্থনের পরিচয়। এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, হ্নআমরা যখন দায়িত্ব নিই প্রথম থেকেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভোটিং আগামী নির্বাচনে চালু করার বিষয়ে উদ্যোগী হই। আমরাও ওয়াদাবদ্ধ, প্রবাসীদের ভোটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাও জাতির কাছে একই ওয়াদা করেছেন। তিনি জানান, প্রবাসীরা তাদের ভোটের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে এসেছেন বরাবরই। গণমাধ্যমেও লেখালেখি দেখি, রাজনৈতিক নেতারাও একই বিষয়ে সোচ্চার।হ্ন আমরা প্রথম থেকেই এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। ইনহাউজ এক্সারসাইজ করেছি, প্রতিষ্ঠান বিশেষজ্ঞদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়েছি। লাগসই অপশন যেটা আমরা ইন্ট্রোডিউস করতে পারি, সেটা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের বিশেষজ্ঞরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন কয়েক মাস ধরে। কিছু সাজেশন দিয়েছেন। আমাদের সময়ের স্বল্পতা, সীবাবদ্ধতার মধ্যে আপনাদের সাথে আলোচনা করে আমরা কী করছি তা তুলে ধরা হচ্ছে। আমরা কী করেছি, কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি, অভিজ্ঞতা কী তা শেয়ার করতে চাই।
বিএনপির বক্তব্য : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ প্রবাসে স্থায়ী হতে যায়, এই তালিকা কোথাও নেই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি, কোথাও নেই। কত প্রবাসী ফিরে এসেছে সেই তালিকাও নেই। কাজেই এসব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়। তিনি বলেন, আমেরিকার নাগরিক বাংলাদেশে এলে তাদের দূতাবাসে রিপোর্ট করতে হয়। আমাদের দেশের নাগরিকদের জন্য এমন সিস্টেম নেই। আমি নিজে দেখেছি অনেক প্রবাসীর পাসপোর্ট নেই। অনেকেই আবার মৃত ব্যক্তির পাসপোর্টে প্রবাসে যায়। তাই শুধু এনআইডি বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করলে হবে না। কেননা সবার এনআইডি নেই। তাই পাসপোর্টও বিবেচনায় নিতে হবে। আবার অনেকের কোনোটাই নেই। এই বিষয়গুলোর কী হবে?
প্রবাসীদের ভোটার করার ব্যাপারে বিএনপি নেতা বলেন, এটা ঠিক যে বহু জেলা আছে যেখানে প্রবাসী খুব কম। আবার কিছু জেলা আছে সেখানে এত প্রবাসী যে তারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি বলেন, প্রভাবিত করলে অসুবিধা নেই। তারা যদি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থাকেও যদি পাল্টে দিতে পারে, দিক না।
জামায়াতের অভিমত : জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমাদের দলীয় ফোরামে বিষয়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। এখানে প্রক্সি ভোটের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ধরে নিলাম এক্স ওয়াইকে প্রতি ভোটের জন্য মনোনীত করল। তাতে ওয়াই এক্সের মনোভাবকে এক্সিকিউট নাও করতে পারেন। যেখানে দেড় কোটি ভোটার আছে। এখানে টেন পার্সেন্টও যদি মিস ইউজ করে এক্সের প্রতিফলন না ঘটায়, তাহলে ভোটের ফল পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রক্সি ভোট করা যায়, তবে তা সঠিক জায়গায় পড়বে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত ৫৪ বছরেও এই প্রবাসীরা তাদের ভোটাধিকার পায়নি। কিন্তু তারাই দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা ও রিজার্ভকে চাঙ্গা রেখেছেন।
জামায়াত নেতা বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে ভোটের নামে যা হয়েছে তাতে মানুষ ইসির প্রতি আস্থাহীনতায় রয়েছে। ১৫৪জন বিনা ভোটে সংসদ নির্বাচন পাস করল। ইসি কিভাবে এটাকে তখন সমর্থন করেছে। তাদের এইসব কর্মকাণ্ডের কারণে ট্রাস্ট ও কনফিডেন্স হারিয়েছে।
অন্যান্য দলের মতামত : গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, তিনটা পদ্ধতির মধ্যেই বেশ দোষ-ত্রুটি রয়েছে। অনলাইন এখনো দেশে সহজলভ্য নয়। যেটা সবার কাছে সহজলভ্য সেটা গ্রহণ করলে ভালো হবে। প্রক্সি ভোটিং ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আরো কিভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি গ্রামগঞ্জে, নিজের পরিবারেও দেখেছি, বাবা একটা দলকে ভোট দেন, মা আরেকটা দলকে ভোট দেন। ভোটের ব্যাপারে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা: মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, অনলাইন পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক দেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর প্রক্সি ভোটিং নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এটাকে নিয়ে আরো পর্যালোচনা করা উচিত। কিছু তো সমস্যা থাকবেই।
এবি পার্টির প্রতিনিধি বলেন, প্রবাসীদের রেজিস্ট্রেশন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আগের পতিত সরকারের আমলে ডাটাবেজ থেকে অনেক তথ্য পাচার হয়েছে। বিদেশে অনেকের এনআইড কার্ড নেই। ফলে পাসপোর্ট ও এনআইডি দুটোকেই নেয়া উচিত। তিনি বলেন, বিদেশে এই নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের প্রচারণা না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।
সিপিবির আক্তার গণি চন্দন বলেন, ভোটিং পদ্ধতির কারণে অনেক কিছুই পাল্টে যেতে পারে। তাই সময় নিয়ে পর্যালোচনা করে এই ভোটিং পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ফয়সাল বলেন, সব প্রবাসী ভোটারকে আমরা হয়তো আনতে পারব না। তবে পাইলট প্রকল্প ভিত্তিতে শুরু করা যায়।
মুসলিম লীগের কাজী আবুল খায়ের বলেন, ২০০৮ সালের পর কেউ ভোট দিতে পারেনি। এই জায়গা থেকে উত্তরণ করতে হবে। প্রবাসীরা ভোট দান করুক, এই উদ্যোগ শুরু হোক।
নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। পদ্ধতি চূড়ান্ত করার বিষয়ে আরো সময় নিয়ে পর্যালোচনা করা উচিত। এখন আমাদের নির্বাচন প্রসেস শুরু করা জরুরি।
এনসিপির সদস্য খালেদ বলেন, অনেকেই প্রক্সি ভোটিং নিয়ে কথা বলছেন। কিছু কিছু অঞ্চল আছে যেখানে প্রবাসী ভোটার অনেক বেশি। সেখানে প্রক্সি ভোট ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।