৫০ আসনে শরিকদের ছাড় দেবে বিএনপি

নির্বাচনী জোটে টানতে পারে এনসিপিকেও

মঈন উদ্দিন খান
Printed Edition

আগামী নির্বাচনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের সর্বোচ্চ অর্ধশত আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি। কোন দলকে কতটি আসন দেয়া যায়, তা নিয়ে এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটি এক্ষেত্রে ‘বিজয়ী হতে সক্ষম’ এবং ‘গ্রহণযোগ্যতা’ রয়েছে, শরীকদের মধ্যে এমন প্রার্থীদের গুরুত্ব দেবে। ঢালাওভাবে কারো হাতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক তুলে দিয়ে আসন হারাতে চায় না বিএনপি। জানা গেছে, নবগঠিত দল এনসিপিকেও বিএনপি নির্বাচনে জোটে টানতে পারে। এমনটি হলে এ দলটির শীর্ষ নেতাদেরও বেশ কয়েকটি আসনে ছাড় দেবে তারা।

লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে ফলপ্রসূ বৈঠকের পর রাজনীতি ধীরে ধীরে নির্বাচনমুখী হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দল রাজনীতির মাঠে নিজেদের প্রার্থিতা জানান দিচ্ছে। চলছে প্রচার-প্রচারণা। জানা গেছে, বিএনপিও তাদের নির্বাচনী জোট গঠন বা জোটের রূপরেখা কেমন হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। বিএনপির জোটসঙ্গী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিজেদের মতো করে চিন্তাভাবনা করছেন। বিএনপি তাদেরকে কত আসন ছাড় দিবে, কে কোথায় নির্বাচন করবেন, তা নিয়ে তারা এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। জোটের শরিক দলগুলো এখনই বিএনপির কাছ থেকে নির্বাচনী জোট গঠনের খুব স্পষ্ট বার্তা আশা করছে। একইসাথে এটি নিয়ে আলোচনাও শুরু করতে চায় তারা।

জানা গেছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল ও শরীকদের মাঝে চূড়ান্তকরণের কাজ এখনো শুরু না করলেও নির্বাচনী জোট নিয়ে ভাবছে বিএনপি। দলটি আগামীতে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ জোটে ছিল কিন্তু আগামীতে এককভাবে নির্বাচন করবে, যারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা বাদে অন্যদের নির্বাচনী জোটে টানার চেষ্টা করবে দলটি। এ ছাড়া যুগপতের বাইরে থাকা অন্যান্য দলকেও গুরুত্ব দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে নিয়েও চিন্তাভাবনা আছে। এনসিপি আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদেরকেও নির্বাচনী জোটে নিতে পারে বিএনপি। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, তারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা মিত্রদের সাথে নিয়ে নির্বাচন করবে এবং তাদেরকে সরকারেও রাখবে।

বিএনপির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ৪০টির মতো রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত ছিল। এগুলোর মধ্যে ছয় দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ১০ দলীয় জোট জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চার দলীয় জোট গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপি, গণফোরাম-বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, এনডিএম অন্যতম।

জানা গেছে, বিএনপি আন্দোলনের এসব মিত্রদের জন্য ‘যৌক্তিক’ সংখ্যক আসন ছাড়বে। যাদের জাতীয় ইমেজ আছে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় যাদের বিজয়ী হওয়ার মতো অবস্থান আছে, তাদেরকে আসন ছাড়বে। এ ছাড়া প্রার্থী দুর্বল হলেও জোটের ঐক্যের স্বার্থেও মিত্রদের কিছু আসন ছেড়ে দেবে বিএনপি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচনী জোট জামায়াতে ইসলামী ছিল এবং তাদেরকে তখন ২২টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল দলটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করতে পারে, সেটি হলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী জোটে থাকছে না জামায়াত। ফলে দলটিকে এবার আর কোনো আসন দেয়ার আলোচনা আসছে না। এ দিকে ২০১৮ সালে নির্বাচনী জোটে না থাকলেও পরবর্তীতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে নতুন কয়েকটি দল সম্পৃক্ত হয়। জোটে আসলে তাদের মধ্য থেকেও কাউকে কাউকে আসন দেয়া হতে পারে। বিএনপি ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে মিত্রদের ৫৯টি আসন ছেড়ে দিলেও সব মিলিয়ে এবার আসন ছাড়ার সংখ্যা ৫০টিরও বেশি হবে না বলে জানা গেছে।

খেঁাঁজ নিয়ে জানা যায়, এনসিপি গঠনের পর থেকেই বিএনপির অভ্যন্তরীণ চিন্তা ছিল যে, গণ-অভ্যুত্থানের দল হিসেবে তাদের সাথে একটা চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখবে। তবে মাঝখানে এনসিপির কিছু কিছু নেতার বিএনপিবিরোধী ক্যাম্পেইনের কারণে বিএনপির ভেতরে একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। বিএনপির অনেকের বিরুদ্ধে তারা অপপ্রচারমূলক বক্তব্যও দেন। অনেকের অভিমত, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এর মধ্য দিয়ে বিএনপিকে ‘মেলাইন’ করার চেষ্টা হয়। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। জানা গেছে, তারপরও এনসিপি আগামীতে যদি বিএনপির নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোটে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে, বৃহত্তর স্বার্থে তাদেরকে জোটে নিতে পারে বিএনপি এবং সেক্ষেত্রে তাদের ফ্রন্টলাইন নেতৃত্বের মধ্যে যারা ‘ক্যাপাবল’, তাদেরকে বেশ কয়েকটি আসন ছেড়ে দেয়া হতে পারে। জানা গেছে, কয়েক মাস আগে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে এ ধরনের একটা আলোচনা হয়েছিল। এনসিপির কে কে নির্বাচন করতে চায়, বিএনপির তরফ থেকে তখন এ ধরনের একটা তালিকাও চাওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য সেটার আর তেমন অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে গত রোববার যুগপতের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে বৈঠক করেছে বিএনপি। মূলত মঞ্চের নেতাদের লন্ডন বৈঠক সম্পর্কে অবহিত করতেই এ বৈঠকটি করে দলটি। সেখানে লন্ডনে গত ১৩ জুন অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ছয় দলীয় এ রাজনৈতিক জোট। তবে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং আসন বণ্টনের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের সময় আরও ঘনিয়ে এলে তখন এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, বিএনপির পক্ষ থেকে গণতন্ত্র মঞ্চকে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদের নিয়েই বিএনপি আগামীতে নির্বাচন করবে এবং মিত্ররা সরকারেও থাকবে। নির্বাচনে বিজয়ী হলে তারা জাতীয় সরকার গঠন করবে। পাশাপাশি যুগপতের শরিক দলগুলোর নেতারা বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও প্রচারণায় নেমে যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপি বলেছে, যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হবে কিংবা বিএনপি যখন যুগপৎ শরিকদের কাউকে ধানের শীষের চূড়ান্ত মনোনয়ন দিবে, তখন এ বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। দলের কেউ তখন ধানের শীষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে, বিএনপি যথারীতি তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিএনপির পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন। অন্য দিকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে বর্তমান সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ূম ও জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ছিলেন।

জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, যুগপতে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে আমরা যুক্ত ছিলাম। এখন নতুন প্রেক্ষিতে দেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্ট ও সরকার গঠন হবে। আর বিএনপি তো বলেই আসছে, যুগপতের শরিকদের নিয়ে তারা সরকার গঠন করবে। তবে স্বাভাবিকভাবে তার আগে তো নির্বাচন। যুগপৎ আন্দোলনের যে ঐক্যটা, আগামী নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে নিশ্চয় সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। সে ব্যাপারে আমাদের মধ্যে এক ধরনের আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া আছে। নির্বাচন আরও এগিয়ে আসলে এ ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্টভাবে আলাপ-আলোচনা হবে। তখন বোঝাপড়ার জায়গাটা আরো বাড়বে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ বিষয়ে বলেন, বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার মধ্যে পরিষ্কার করে বলা আছে যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয়লাভের পর ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একাধিকবার এ কথাটি বলেছেন। অর্থাৎ আমাদের কমিটমেন্ট আছে। এ কমিটমেন্ট কোথায়, কিভাবে অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে- সেটা এখনই বলা যাবে না, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তা বলা যাবে।