মোজাহিদ হোসেন
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের সবদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী। তারই মধ্যে পদ্মা ও গড়াই দুই প্রাচীন নদীর মিলনস্থল, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়ার মোহনায়। প্রকৃতি এখানে যেন নিজ হাতে আঁকে জলছবির মতো নিখুঁত এক দৃশ্যপট। আর সেই মনকাড়া মোহনার ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা গেলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা।
প্রতিদিনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যস্ততা, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টিউটোরিয়াল, পরীক্ষা আর পাঠ্যসামগ্রীর চাপে বন্দী হয়ে পড়া মন খুঁজছিল একটু স্বস্তির পরশ। সেই কাক্সিক্ষত পরশ মিলে গেল এই নদীভ্রমণে। মঙ্গলবার সকালে দলবেঁধে রওনা হই আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসে। গন্তব্য পদ্মা ও গড়াইয়ের মিলনস্থল। মুখে ছিল উচ্ছ্বাস, চোখে ছিল বিস্ময় আর হৃদয়ে ছিল এক অনাবিল প্রশান্তি পাওয়ার প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে গেলাম আমরা মোহনায়।
প্রথমেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে হরিপুর ব্রিজ। ব্রিজ থেকে দুই পাশে গড়াই নদের উপচেপড়া সৌন্দর্য দেখতে পাই। সেখানে থেকে নৌকা নিয়ে চলে গেলাম পদ্মার সংযোগস্থলে। এখানে গড়াই ও পদ্মা নদীর যুগলবন্দী। গড়াই এসে মিশেছে পদ্মার সাথে। ভারত থেকে গঙ্গা রাজশাহীতে ঢুকেছে। তারপর পদ্মা হয়ে মিলিত হয়েছে মেঘনায়। গড়াই এখানে মিলিত হওয়ায় তিনটি নদীপথ। পদ্মার একদিকে কলকাতা, অন্য দিকে বাংলাদেশ। কুষ্টিয়ার এখান থেকে গোয়ালন্দ। গড়াই গেছে শিলাইদহ হয়ে রাজবাড়ীতে। ফলে অপরূপ এক মোহনা সৃষ্টি হয়েছে কুষ্টিয়া শহরের কাছে হরিপুরে। নয়নাভিরাম এই স্থানকে স্থানীয়রা বলেন ত্রিমোহনা। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ে এক মনোরম আবেশ সৃষ্টি হয় এখানে। বিকেলে সময় কাটাতে কুষ্টিয়া শহরসহ অন্য এলাকার ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন প্রতিদিন। বিস্তীর্ণ জলরাশির গড়াই-পদ্মার এই মোহনাকে সাগর বলে আপনার কাছে ভুল মনে হবে না।
এতে আমরা নৌকা ভ্রমণের আনন্দও উপভোগ করি। গড়াই-পদ্মার মিলনস্থলে নৌকাভ্রমণ দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা। জেলেদের মাছ ধরা, নৌকায় মালামাল পরিবহন, রঙিন নৌকায় ঝলমলে রোদের ঝিলিক অপূর্ব সৌন্দর্যের অবতারণা করে। ওপারের সবুজ গাছগাছালি ও চরাঞ্চলের সবুজ ক্ষেতের মনোরম দৃশ্যও দুচোখ ভরে দেখার মতো। সন্ধ্যাবেলায় নৌকাগুলো যেন পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির। পাশ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভুটভুট শব্দে এ যেন মাতোয়ারা এক ত্রিমোহনা। নৌকা দিয়ে নদীর মাঝখানে গিয়ে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হয়। আমরা চলে যাই মোহনায়। সেখানে গিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য আমাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল। খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস, নদী, পানির ঢেউ সত্যি আশ্চর্যজনক। সেখানে গিয়ে আমরা বন্ধুরা দুই ভাগ হয়ে শুরু করি ফুটবল খেলা। দীর্ঘ সময় ধরে ফুটবল খেলি, এরপর নদীর মধ্যে সবাই লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করি এবং মাছ ধরি। সেখানে গিয়ে মাছ ধরার যে আনন্দ যে উচ্ছ্বাস তা সত্যি অসাধারণ। এই আনন্দ আমাদের মনে জাগিয়েছিল অনাবিল প্রশান্তি।
নদী ভ্রমণে আমরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করি। নদীকে নিয়ে অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক যে এত এত সাহিত্য তথা কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী এবং নদী পাড়ের মানুষের জীবনকাহিনী রচনা করেছে তার বাস্তবিক অভিজ্ঞতা লাভ করি। কবি সাহিত্যিকরা যে তাদের লেখনিতে অসাধারণভাবে নদী, নদীর পানি, নদীর ঢেউ নিয়ে অসংখ্য রচনা করেছেন, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি।
পদ্মার ওপারে পাবনা, পারমাণবিক কেন্দ্র রূপপুর। আরো আছে বিস্তীর্ণ বালুচর। সবুজের সমারোহ। নৌকার চলাচল আর ছোট ছোট লঞ্চে মাঝিদের জীবনের গল্প। নদীতে নেমে গেলে মনে হয় সাগর। কী বিশালতা। চার দিকে শুধু থইথই পানি আর পানি। এর মাঝে নৌকা ভাসছে, দুলছে। আমাদেরও ভাসতে ইচ্ছা করে। তাদের নিয়ে নাও ভাসালাম মাঝ দরিয়ায়। কিছুদূর যেতেই ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা এই ডোবে এই ভাসে অবস্থা।
পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াই। গড়াই নদের আর এক প্রান্ত গিয়ে মিশেছে মধুমতীতে। এই মিলনস্থল থেকে কিছুদূর গেলেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এটি দেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু। তার আগেই পড়বে লালন শাহ সেতু। আর এক তীরে দেশের বৃহত্তম ডিজেলচালিত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। একটু সময় করে নৌকাভ্রমণে দেখা মিলবে এতগুলো বিখ্যাত স্থাপনার।
পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়। এটি হিমালয়ে উৎপন্ন গঙ্গানদীর প্রধান শাখা এবং বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী এই পদ্মার উত্তর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশে নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার (নদী রক্ষা কমিশন রিপোর্ট ২০২৩) গড় প্রস্থ ১০ কিলোমিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার।
গড়াই নদী গঙ্গা তথা পদ্মার একটি প্রধান শাখানদী হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। গড়াই নদীটি কুষ্টিয়া জেলার হরিপুর ইউনিয়নে প্রবহমান পদ্মা নদী হতে উৎপত্তি লাভ করে মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদীতে পতিত হয়েছে। একসময় গড়াই নদী দিয়ে গঙ্গার প্রধান ধারা প্রবাহিত হতো, যদিও হুগলি-ভাগীরথী ছিল গঙ্গার আদি ধারা। কুষ্টিয়া জেলার উত্তরে হার্ডিঞ্জ সেতুর ১৯ কিলোমিটার ভাটিতে তালবাড়িয়া নামক স্থানে গড়াই নদী পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গণেশপুর নামক স্থানে ঝিনাইদহ জেলায় প্রবেশ করেছে।
এই নদী উৎপত্তিস্থল থেকে কামারখালী পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে নৌকা ও অন্য ছোট নৌযান চলাচল করে। কিন্তু শুকনো মৌসুমে এ অংশ অনাব্য হয়ে পড়ে। কামারখালী থেকে ভাটির অংশ মোটামুটি নাব্য, সারা বছর এখানে নৌযান চলাচল করতে পারে। নদীটির মোহনা থেকে উজানে কামারখালী পর্যন্ত অংশ জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত হয়। পদ্মার সাথে সংযুক্ত হওয়ায় নৌপথে পণ্য আদান প্রদানে বিশেষ সহযোগী হিসেবে কাজ করে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক জনপদ। নদীতে প্রচুর পরিমাণ মাছ রয়েছে, যা এ অঞ্চলের মানুষ আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।
সূর্যের রক্তিম আভা পানিতে আছড়ে পড়ছে। সূর্যাস্তের লাল আভা গিলে খাচ্ছে নদীর স্রোত। এই সৌন্দর্য না দেখলে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এখান দিয়েই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা-শিলাইদহ যাতায়াত করতেন। পদ্মা ও গড়াই নদীর স্মৃতি নিয়ে অনেক কবিতা-গান লিখেছেন কবি। গড়াইকে তিনি বলতেন গোড়াই। তার লেখায় বহুবার এ নদী দু’টির প্রসঙ্গ এসেছে। গড়াই নদীকে কবি লিখতেন গৌরী নামে। আবার কখনো কখনো গোড়াই নামেও লিখেছেন তার কবিতায়। গড়াইয়ের নদীতীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে অত্যন্ত নান্দনিকভাবে। এমনটা উল্লেখ আছে তার কবিতায় ‘গোড়াই নদীর চর/নূতন ধানের আঁচল জড়ায়ে ভাসিছে জলের পর/একখানা যেন সবুজ স্বপন একখানা যেন মেঘ/আকাশ হইতে ধরায় নামিয়া ভুলিয়াছে গতিবেগ/দুপুরের রোদে আগুন জ্বালিয়া খেলায় নদীর চর/দমকা বাতাসে বালুর ধূম্র উড়িছে নিরন্তর/রাতের বেলায় আঁধারের কোলে ঘুমায় নদীর চর/জোনাকি মেয়েরা স্বপনের দীপ দোলায় বুকের পর।’
এত সবকিছু মিলে আমাদের এই ভ্রমণ শুধু বিনোদনের সীমায় আবদ্ধ ছিল না; বরং নদী ও তার আশপাশের জীবনের সাথে একটি নিবিড় সংযোগ তৈরি করেছিল। নদী যে বাঙালির জীবন, সাহিত্যের প্রাণ, এই যাত্রা যেন সেই সত্যকেই আবার স্মরণ করিয়ে দিলো।
পদ্মা ও গড়াইয়ের মিলনমোহনায় দাঁড়িয়ে আমরা শুধু একটি ভৌগোলিক স্থানই দেখিনি, দেখেছি বাংলার সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত উৎস। এই অভিজ্ঞতা আমাদের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেবে, ভবিষ্যৎ পাঠ, গবেষণা ও সৃষ্টিশীলতায় এনে দেবে নতুন মাত্রা। এই ভ্রমণ প্রমাণ করল, প্রকৃত শিক্ষা কখনো চারদেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে থাকে নদীর স্রোত, মাটির গন্ধ আর মানুষের গল্পে।
লেখক : শিক্ষার্থী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া