লিবিয়ায় বৈধভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলা থাকলেও দেশটিতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে একজন শ্রমিকও যেতে পারেনি। তবে অবৈধভাবে দুবাইসহ কয়েক দেশে ট্রানজিট যাত্রী হয়ে দালালের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পাড়ি জমাচ্ছেন শত শত বাংলাদেশী। আর এসব বাংলাদেশীরাই লিবিয়ায় নামার পরই অপহরণকারীদের টার্গেটে পড়ছেন। মাফিয়া চক্রের কবলে পড়ে অনেকেই দেশটির বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকছেন। কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন।
এমন শত শত ডিটেনশন ক্যাম্পে বাংলাদেশীরা আটকে আছেন বলে দীর্ঘদিন থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগের সূত্র ধরে সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়ান পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অপহরণকারীদের আস্তানা থেকে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের উদ্ধারও করছেন।
সর্বশেষ গত ১ এপ্রিল লিবিয়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল মিসরাতা শহরে অভিযান চালিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে (মাফিয়াদের আস্তানা) আটকে রাখা ২৩ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেন। এ সময় তারা অপহরণকারী চক্রের সক্রিয় দুই সদস্যকেও গ্রেফতার করেন। এর আগে অবশ্য মিসরাতার আল-গিয়ান থানায় বেশ কয়েকজন বিদেশীকে অপহরণ ও মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডি তদন্ত শুরু করে। তদন্তে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের অবস্থান নিশ্চিত হয়েই সিআইডি সেখানে সফল অভিযান পরিচালনা করে জিম্মি বাংলাদেশী ২৩ নাগরিককে উদ্ধার করে। পরে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি ও গ্রেফতারকৃতদের আইনি প্রক্রিয়ার জন্য আল-গিরান থানায় হস্তান্তর করা হয় বলে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়। এমন ঘটনার পরই লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে মিসরাতার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। একই সাথে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশীদের প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য মিশরাতা কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশ দূতাবাস সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছে বলেও জানানো হয়। এই ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া ২৩ বাংলাদেশীকে কোথায়, কিভাবে রাখা হয়েছে তা জানতে গতকাল রোববার লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকেই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রবাসী কল্য্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের (মিশন) সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লিবিয়ার সিআইডি পুলিশ অপহৃত ২৩ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করার সাথে সাথে দুই অপহরণকারীকেও গ্রেফতার করে। তবে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা কোন দেশী তা জানাতে পারেনি। বলা হয়, পরে উদ্ধার হওয়া ২৩ বাংলাদেশীদের আইনি প্রক্রিয়া শেষে মুক্ত করে দেয়া হয় এবং অপহরণকারীদের আল গিরান থানায় হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যার আগে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশারের সাথে বাংলাদেশী অপহরণ এবং লিবিয়ার শ্রমবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তবে দূতাবাস সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকর্তা নিজের পরিচয় না দিয়ে বলেন, লিবিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একমাত্র রাষ্ট্রদূত ছাড়া তারা কেউ কোনো মন্তব্য করতে পারবে না। তবে যে ২৩ বাংলাদেশী অপহরণ হয়েছিলেন তারা লিবিয়ার সিআইডি পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে এবং যে যার মতো লিবিয়াতে এখন মুক্তভাবে চলাফেরা করছে। ঘটনাটি মিশরাতায় হওয়ায় অপহরণের শিকার কারো মোবাইল নম্বর তাদের কাছে নেই বলেও দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিবিয়ার ডিটেনশন কাম্পগুলোতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে জিম্মি করে মাফিয়া চক্রের সদস্যরা নানাভাবে তাদের স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করছে। অবৈধভাবে পাড়ি দেয়া বেশির ভাগ বাংলাদেশীদের টার্গেট হচ্ছে সাগরপথে ইউরোপের দেশ ইতালি পাড়ি জমানো। এই পাড়ি জমাতে গিয়েই তারা মাফিয়াদের টার্গেটে পড়ছেন। জানা গেছে, লিবিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে অবৈধভাবে দেশটিতে যাওয়া শত শত বাংলাদেশী এখনো আটকে আছে। তাদের জীবন কাটছে দুর্বিসহ। আবার বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইওএম এর সহযোগিতায় অনেকেই জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরছেন।
গতকাল রোববার রাতে জনশক্তি ব্যবসায়ী ও রিক্রুটিং এজেন্সি সোনার বাংলা কৃষি খামার এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, লিবিয়ার সাথে বাংলাদেশের একটি সুদীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। লিবিয়া সরকার বিদেশী বৈধ কর্মীদের নিয়োগ ও সুরক্ষার জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, বিগত দুই বছর ধরেই লিবিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের বারবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠক করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যেন অবৈধভাবে কোনো লোক লিবিয়াতে না আসে। সতর্কও করা হচ্ছে। তারপরও অবৈধ অভিবাসন বন্ধ না হওয়ায় একপর্যায়ে তারা বলেই দিয়েছে, অবৈধদের কোনো দায় লিবিয়া সরকার নেবে না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবৈধভাবে লিবিয়া অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্ত চোরাচালান কারবারীদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণসহ নানাধরনের গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ অপহরণকারী ও মানবপাচারকারী চক্র তৈরি করে স্বদেশীদের অপহরণ করে গুরুতর অপরাধ সংগঠিত করছে এবং অপহৃতদের স্বজনদের কাছে তারা মোবাইল কল করে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে হাতিয়ে নিচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো একটি পত্রে উল্লেখ করা হয়, লিবিয়ায় অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ২ হাজার ৬৫০ জন বাংলাদেশীকে আইএমও এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপরও থামছে না সাগরপথে অবৈধভাবে লিবিয়া দিয়ে ইউরোপের দেশ ইতালি পাড়ি জমানো।
ফকিরাপুল এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এই মুহূর্তে বৈধভাবে জনশক্তি রফতানির পথ অনেকটাই বন্ধ। লিবিয়ার শ্রমবাজারতো অনেক দিন ধরেই বন্ধ। এই সুযোগে ঢাকা থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত মানবপাচারকারী চক্র ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে দুবাই নিচ্ছে। সেখানে ট্রানজিট হয়ে লিবিয়া নিচ্ছে। এরপর নেয়া হয় বেনগাজি। সেখান থেকে বের হওয়ার পরই কেউ কেউ টার্গেটে পড়ছে অবৈধপথে পা বাড়ানো সহজ-সরল মানুষগুলো। আর এসব লোককে ঢাকার বিমানবন্দর দিয়ে নিরাপদে পার হতে সহযোগিতা করছে এক শ্রেণীর (বডি কন্ট্রাক্ট) দালাল। যার কারণে অবৈধভাবে লিবিয়া যাওয়া কমছে না বলে তারা মনে করছেন।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবৈধপথে লিবিয়ায় লোক যাওয়ার হার কমাতে হলে অবশ্যই ঢাকার বিমানবন্দরকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। নতুবা এসব মানুষ কাজের খোঁজে গিয়ে হয় লিবিয়ার ডিটেনশন সেন্টারে আটকে থাকবেন, নতুবা তাদের সাগরে সলীল সমাধি ঘটবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে কোনো শ্রমিক বৈধভাবে দেশটিতে যায়নি।