
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল আমাজনকে ঘিরেই শুরু হয়েছে জাতিসঙ্ঘের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন (COP30)। ব্রাজিলের বেলেম শহরের হ্যাঙ্গার কনভেনশন অ্যান্ড ফেয়ার সেন্টার অব দ্য অ্যামাজনসে সোমবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন শুরু হয়।
প্রায় ১৯০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, প্রতিনিধি, পরিবেশবিদ ও গণমাধ্যমকর্মী এতে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকেও সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকদের একটি দল উপস্থিত আছেন।
তাদের মধ্যে আছেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, যিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদকও।
তিনি এই কপ৩০ সম্মেলনকে আখ্যা দিয়েছেন- ‘আমাজনের বুকে নতুন জলবায়ু যুদ্ধ’। নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায্য অধিকার ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে তার বিশ্লেষণ।
কপ৩০-এর মূল লক্ষ্য কী?
অধ্যাপক মজুমদার : বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন করে নির্গমন কমানোর পরিকল্পনা (ঘউঈ) জমা দিতে হবে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী পৃথিবীর গড় উষ্ণতা যেন ১.৫ ডিগ্রির বেশি না বাড়ে- এটি নিশ্চিত করাই কপ৩০-এর মূল উদ্দেশ্য।
আমাজন কেন সম্মেলনের কেন্দ্র?
আমাজন বনভূমি প্রতি বছর কোটি টন কার্বন শোষণ করে পৃথিবীর জলবায়ু ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু বন উজাড়, আগুন ও খনন কার্যক্রমের কারণে এটি এখন উল্টো কার্বন নিঃসরণের উৎসে পরিণত হচ্ছে। তাই আমাজনকে রক্ষা করা এখন বৈশ্বিক অগ্রাধিকার।
বিশ্ব এখন কতটা ঝুঁকিতে?
জাতিসঙ্ঘের হিসাবে জলবায়ুজনিত দুর্যোগে প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, আর ২০২৪ সালেই বিশ্বজুড়ে ১১ কোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও অগ্নিকাণ্ড ক্রমেই বেড়ে চলেছে- যা এখন বৈশ্বিক নিরাপত্তারও বড় চ্যালেঞ্জ।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায়িত্ব কি সমান?
না। ‘অভিন্ন কিন্তু পৃথক দায়িত্ব’ নীতির অধীনে শিল্পোন্নত দেশগুলোরই ঐতিহাসিকভাবে বেশি দায়, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করেছে। তাই তাদেরকেই প্রযুক্তি ও অর্থ সহায়তার ভার বহন করতে হবে, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
ছোট দ্বীপরাষ্ট্র ও দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থান কী?
এসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলেও তাদের নিঃসরণ অতি নগণ্য। তারা এবার ক্ষতিপূরণ ও অভিযোজন তহবিলের জন্য জোর দাবি তুলেছে। কপ৩০ তাদের জন্য ন্যায্য অধিকার আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ তৈরি করেছে।
জলবায়ু তহবিল ইস্যুতে নতুন কী আছে?
১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত তহবিল এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এবার একটি নতুন অর্থায়ন কাঠামো ও স্বচ্ছতা ব্যবস্থা আনার প্রস্তাব এসেছে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সরাসরি ও দ্রুত অর্থ পেতে পারে।
কপ৩০ থেকে কী ধরনের সিদ্ধান্ত আশা করছেন?
২০৩৫ সালের মধ্যে নতুন নির্গমন কমানোর রোডম্যাপ, ক্ষতিপূরণ ও অভিযোজন তহবিলের দ্রুত বাস্তবায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর এসব বিষয়ে বাধ্যতামূলক চুক্তি হবে বলে আশা করছি। এ ছাড়া বন সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়াও জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আপনার মূল বার্তা কী?
‘পৃথিবী এখন জলবায়ুর যুদ্ধে এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে। কপ৩০ শুধুই আলোচনার নয়- এখন বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার সময়। আমাজনের মতো জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থলগুলোকে রক্ষা করতে না পারলে পৃথিবী আর টিকবে না।’
কপ২৯ থেকে বাংলাদেশের অর্জন : ২০২৪ সালের কপ২৯ (বাকু, আজারবাইজান) সম্মেলনে বাংলাদেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য পায়, যার মধ্যে রয়েছে- জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি- নতুন ও অতিরিক্ত তহবিল নিশ্চিতে সক্রিয় ভূমিকা। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ কার্যকর করার দাবি- সরাসরি অর্থপ্রাপ্তির পক্ষে জোরালো অবস্থান। অভিযোজন মডেলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি- বাংলাদেশের কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজনকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ। নবায়নযোগ্য শক্তি অংশীদারিত্ব- ইইউ ও বিশ্বব্যাংকের সাথে ‘জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন’ উদ্যোগে অংশগ্রহণ। নারী ও যুব নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি। নতুন জাতীয় জলবায়ু অর্থনীতি রোডম্যাপ প্রস্তুত।
বিশ্ব মোড়লদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব?
আশার দিক হলো : কপ২৯-এর ‘নতুন সমষ্টিগত অর্থায়ন কাঠামো’ (ঘঈছএ) বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণ ইস্যুতে আগের চেয়ে বেশি অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায্যতা প্রশ্নে উচ্চতর মনোযোগ।
শঙ্কার দিক হলো : ঘোষিত অর্থের পরিমাণ এখনো অপর্যাপ্ত। তহবিলের বড় অংশ ঋণ বা বেসরকারি বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। বাস্তবায়ন কাঠামো দুর্বল ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বড় বাধা। ‘আমি মধ্যম আশাবাদী- বড় সাফল্য হয়তো একবারে আসবে না, কিন্তু ধাপে ধাপে অগ্রগতি হবে।’
বাংলাদেশের প্রস্তুতি কী হওয়া উচিত?
ক্ষেত্রভিত্তিক স্পষ্ট প্রকল্প ও পরিকল্পনা তৈরি; স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা; অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণ খাতে অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার সবশেষে বলেন-‘আমাজন শুধু একটি বন নয়; এটি পৃথিবীর ফুসফুস। এখান থেকে শুরু হচ্ছে এক নতুন জলবায়ু যুদ্ধ- যেখানে বেঁচে থাকার লড়াই শুধু প্রাণিকুলের নয়, মানবজাতিরও।’



