খুলনা ব্যুরো/ চুয়াডাঙ্গা/ সাতক্ষীরা/ বেনাপোল/ বান্দরবান প্রতিনিধি
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের প্রাক্কালে দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, টার্গেটেড হামলার অভিযোগ, অগ্নিসংযোগ এবং সীমান্তঘেঁষা নিরাপত্তাঝুঁকি একযোগে বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। খুলনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতাকে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনার পর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তজুড়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে।
তবে ঘটনার প্রাথমিক রাজনৈতিক বয়ানের সাথে পুলিশের তদন্তে পাওয়া বাস্তব চিত্রের গুরুতর অমিল পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ঘটনার প্রকৃতি যাই হোক, এর রাজনৈতিক ব্যবহার ও সীমান্তঘেঁষা সতর্কতা মিলিয়ে একটি ‘নিরাপত্তা সেনসিটিভ মোমেন্ট’ তৈরি হয়েছে।
২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বহু আকাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের দিন ধার্য হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের এই তফসিল ঘোষণা করা হয়। দেশের ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন এবং একই সাথে জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫-এর ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল অনুসারে মনোনয়নপত্র জমা ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৪ জানুয়ারি রোববার পর্যন্ত মনোনয়ন যাচাই-বাছাই হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ জানুয়ারি। নির্বাচনী প্রচারণা চলবে আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ লক্ষ্যে প্রার্থী মনোনয়নের কাজ চালাচ্ছে। মনোনয়ন ফরম উত্তোলনের কাজও চলমান।
এই অবস্থায় তফসিল ঘোষণার পর দিন জুলাই যোদ্ধা ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থান বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মারা যান। এর পর থেকে কার্যত দেশজুড়ে নির্বাচনী সহিংসতা বৃদ্ধি পায় এবং টার্গেটেড হামলার অভিযোগ আসতে থাকে। এ দিকে ময়মনসিংহে ধর্ম অবমাননার নাম করে একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়।
খুলনায় এনসিপি নেতা গুলিবিদ্ধ : যা ঘটেছে
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও শ্রমিক উইংয়ের খুলনা বিভাগীয় সংগঠক মোতালেব শিকদার (৪২) গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানার মজিদ সরণি এলাকার একটি ফ্ল্যাটে গুলিবিদ্ধ হন।
প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি রাজনৈতিক হত্যাচেষ্টা হিসেবে প্রচারিত হলেও পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তা হাউজের নিচতলার ওই ফ্ল্যাটে মোতালেব শিকদার এক নারীসহ কয়েকজন সহযোগীর সাথে মদ্যপান ও ইয়াবা সেবনে যুক্ত ছিলেন। এ সময় নিজেদের মধ্যে বিরোধের জেরে উপস্থিত একজন তাকে গুলি করে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি নিজেই রিকশায় করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান, যা ঘটনাটির রাজনৈতিক অ্যামবুশ তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার আলামত : পুলিশ, সিআইডি, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর তল্লাশিতে ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়- একাধিক মদের বোতল; ইয়াবা ও মাদক সেবনের সরঞ্জাম; ব্যবহৃত গুলির খোসা; রক্তমাখা কাপড়। এ ঘটনায় ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া তন্বী নামে এক নারী পলাতক রয়েছেন, যিনি নিজেকে এনজিও কর্মী পরিচয় দিয়ে মাত্র ১ ডিসেম্বর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন। বাড়িওয়ালার ভাষ্য অনুযায়ী, ফ্ল্যাটটিতে নিয়মিত অসামাজিক কার্যকলাপ চলছিল এবং নোটিস দেয়ার আগেই এই ঘটনা ঘটে।
পুলিশের বক্তব্য : রাজনৈতিক হামলার প্রমাণ মেলেনি
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “ভিডিও ফুটেজ ও আলামত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটি কোনো রাজনৈতিক টার্গেট কিলিং নয়। নারী, মাদক ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকেই গুলির ঘটনা ঘটেছে।” চিকিৎসকরাও নিশ্চিত করেছেন, গুলিটি মাথার ভেতরে প্রবেশ করেনি এবং মোতালেব শিকদার বর্তমানে শঙ্কামুক্ত।
তবু কেন সীমান্তজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা : ঘটনার প্রকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি ও পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দাবি ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেই দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তজুড়ে নজিরবিহীন সতর্কতা জারি করে বিজিবি। এর মধ্যে রয়েছে- চুয়াডাঙ্গা (৬ বিজিবি)- দামুড়হুদা সীমান্তে ১১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে টহল; কাঁটাতারবিহীন এলাকা কার্যত সিল; দর্শনা আইসিপিসহ একাধিক বিওপিতে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন; সাতক্ষীরা (৩৩ বিজিবি); ভোমরা স্থলবন্দরসহ সীমান্ত কার্যত বন্ধ; ৫৭টি চেকপোস্ট সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ; কৃষিকাজ পর্যন্ত সাময়িকভাবে বন্ধ; বেনাপোল (৪৯ বিজিবি)- ৭০ কিলোমিটার সীমান্তে কড়া তল্লাশি; কাঁটাতারবিহীন অঞ্চল লকডাউন। বিজিবির ভাষ্য অনুযায়ী, এটি একটি প্রিভেন্টিভ সিকিউরিটি মেজার, যাতে কোনো আসামি সীমান্ত অতিক্রম করে পালাতে না পারে।
উল্লেখ্য, ওসমান হাদি হত্যার আসামিরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পুলিশ বলেছে, আসামিদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে নেই।
বান্দরবানে অগ্নিসংযোগ : নিরাপত্তা চাপে নতুন মাত্রা
এরই মধ্যে বান্দরবানে সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুরের বাসভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পার্বত্য অঞ্চলেও উদ্বেগ বাড়ে। এনসিপি এটিকে রাজনৈতিক ভীতি ও টার্গেটেড সহিংসতার ধারাবাহিকতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। দলটির মতে, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও শক্তিগুলো ক্রমাগত ঝুঁকিতে পড়ছে।
বিশ্লেষণ : বাস্তব ঘটনা বনাম রাজনৈতিক বয়ান
এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-
১. বাস্তব অপরাধ ও রাজনৈতিক বয়ানের বিচ্ছিন্নতা
২. একটি অপরাধকে ঘিরে বৃহৎ নিরাপত্তা প্রতিক্রিয়া
৩. নির্বাচনপূর্ব সময়ে সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অতিসংবেদনশীলতা
বিশ্লেষকদের মতে, যদিও গুলির ঘটনাটি রাজনৈতিক হামলা হিসেবে প্রমাণিত হয়নি, তবু রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ভিন্ন বয়ান তৈরি; সীমান্তপথে অপরাধী পালানোর আশঙ্কা; বিভিন্ন অঞ্চলে সমসাময়িক সহিংসতা- এই তিনটি মিলিয়ে রাষ্ট্রকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি (ডড়ৎংঃ-পধংব ঝপবহধৎরড়) ধরে প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করেছে।
বড় প্রশ্ন : রাজনৈতিক পরিচয় থাকা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত অপরাধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সঙ্কটে পরিণত হচ্ছে কেন? সীমান্ত নিরাপত্তা কি কেবল অপরাধী ধরার জন্য নাকি সম্ভাব্য অস্থিরতা ঠেকানোর কৌশল? নির্বাচনমুখী সময়ে এই ধরনের ঘটনা কি রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো বাড়াবে?
খুলনার এই গুলির ঘটনা এক দিকে আইনশৃঙ্খলা, মাদক ও অপরাধ জগতের ভয়াবহ সংযোগ প্রকাশ করেছে, অন্য দিকে রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার কিভাবে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে, সেটিও স্পষ্ট করেছে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এখন সবচেয়ে জরুরি : দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত; রাজনৈতিক বয়ান নয়, প্রমাণভিত্তিক তথ্য প্রকাশ; সীমান্ত সতর্কতার সাথে নাগরিক জীবনের ভারসাম্য রক্ষা। তা করা হলে বিচ্ছিন্ন অপরাধও জাতীয় নিরাপত্তার বড় সঙ্কেত হয়ে উঠতে পারে।



