রাজউক সংস্কার- ১

ডিসেম্বরের মধ্যেই নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের উদ্যোগ

নতুন আইনের উদ্দেশ্য হলো মূলত ঢাকাসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকা যেমন টঙ্গী শিল্পাঞ্চল, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনা এবং ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’কে (রাজউক) শক্তিশালী ও কার্যকর করা।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

সরকার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনকে যুগোপযোগী করে নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ‘দি টাউন ইম্প্রোভমেন্ট অ্যাক্ট’ প্রতিস্থাপন করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর খসড়া অধ্যাদেশের ওপর এক বৈঠক গত শুক্রবার বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং সংশ্লিষ্ট সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। সভায় চূড়ান্ত খসড়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় এক-দুই মাসের মধ্যে আইনটি চূড়ান্ত করা হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোর দুর্বলতা ও পরিবেশগত সঙ্কট দীর্ঘদিন ধরেই নগর ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তুলেছে। ১৯৫৩ সালের ঞযব ঞড়হি ওসঢ়ৎড়াবসবহঃ অপঃ (ঊধংঃ ইবহমধষ অপঃ ঘড়. ঢওওও ড়ভ ১৯৫৩) মূলত রাজধানী ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য গৃহীত হলেও সময়ের সাথে সাথে তা যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। ফলে নগরায়ন, অবকাঠামো ও জনসেবার সমন্বিত পরিকল্পনায় একটি নতুন আইন জরুরি হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণীত হয়েছে। আইনটি তৈরি করা হয়েছে মূলত বিদ্যমান আইনের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ হিসেবে।

নতুন আইনের উদ্দেশ্য হলো মূলত ঢাকাসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকা যেমন টঙ্গী শিল্পাঞ্চল, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় আনা এবং ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’কে (রাজউক) শক্তিশালী ও কার্যকর করা। নতুন আইনে নগরায়ন, জনসেবা, অবকাঠামো, পুনর্বাসন, পরিবেশসংরক্ষণ, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা (উবঃধরষবফ অৎবধ চষধহ) বাস্তবায়নের জন্য আধুনিক উপাদান সংযোজন করা হয়েছে।

কাঠামো ও সংজ্ঞা : অধ্যাদেশে ২৯টি সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যেকোনো ইমারত নির্মাণ, পুনর্গঠন, রাস্তা-ড্রেনেজসহ ভূখণ্ডের উন্নয়ন। এর ধারা ১৯ অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনাকে এর আওতায় আনা হয়েছে। এতে রয়েছে কৌশলগত পরিকল্পনা ও বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা যা দীর্ঘমেয়াদি নগর নীতিমালার ভিত্তি। পুনঃউন্নয়ন ও পুনর্বিন্যাসকেও এর আওতায় আনা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে- একাধিক প্লট একীভূত করে আধুনিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুনভাবে বিতরণ। উন্নয়নস্বত্ব হস্তান্তরের বিষয়ও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিবেশসংবেদনশীল এলাকা সংরক্ষণের স্বার্থে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে উন্নয়ন অধিকার হস্তান্তর রয়েছে এতে। এই সংজ্ঞাগুলোতে নগর ব্যবস্থাপনায় আধুনিক আন্তর্জাতিক ধারণা প্রতিফলিত করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের গঠন : অধ্যাদেশে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’কে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একজন চেয়ারম্যান এবং প্রশাসন ও অর্থ, এস্টেট ও ভূমি, নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ইঞ্জিনিয়ারিং- এই পাঁচ খাতভিত্তিক সদস্য থাকবে। গৃহায়ন, ভূমি, পরিবেশ ও দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে বোর্ডে থাকবেন। চেয়ারম্যান সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন; টানা দুই মেয়াদের বেশি তিনি থাকতে পারবেন না। এই কাঠামো কার্যত সরকার, সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

ক্ষমতা ও দায়িত্ব : নতুন আইনে রাজউককে দেয়া হয়েছে বিস্তৃত ক্ষমতা। এর আওতাভুক্ত এলাকায় টেকসই নগরায়ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন থাকবে। ভূমির ন্যায্য ব্যবহার, পুনঃউন্নয়ন ও পুনর্বিন্যাস নিশ্চিতকরণও থাকবে সে সাথে। ঝুঁকিপূর্ণ, বস্তি বা অপরিকল্পিত এলাকাকে পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে মানোন্নয়ন করা হবে। আবাসন, পুনর্বাসন, সড়ক, জলাশয় ও জনসেবার অবকাঠামো উন্নয়ন করবে রাজউক। সংরক্ষিত এলাকা, খোলা স্থান ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষাও রাজউকের দায়িত্বে থাকবে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার, সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ও অংশীদারিত্ব করবে রাজউক। নাগরিক চার্টার প্রকাশ ও তথ্যপ্রচার কাজও করবে যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ে।

আধুনিক ধারা : নতুন অধ্যাদেশে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা আগের আইনটিতে ছিল না। এর মধ্যে রয়েছে- কৌশলগত পরিকল্পনা ও বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা বাধ্যতামূলকভাবে থাকা। টিডিআর বা উন্নয়নস্বত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশ্বমানের পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। পুনর্বাসন ও বস্তি উন্নয়নকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনা হয়েছে। নাগরিক অংশগ্রহণ ও জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ পরিকল্পনা অনুমোদন ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।

তাৎপর্য : এই উদ্যোগের বিশেষ তাৎপর্য হলো- ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত হবে। স্থানীয় সরকার, মন্ত্রণালয় ও রাজউকের মধ্যে দ্বৈধতা ও সমন্বয়ের অভাব হ্রাস পাবে। উন্নয়নস্বত্ব হস্তান্তর ও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ভূমির চাপ কমবে এবং পরিবেশ সংরক্ষিত থাকবে। আবাসন সঙ্কট, জনসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নে আইনগত ভিত্তি তৈরি হবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, নাগরিক চার্টার ও তথ্যপ্রচারের মাধ্যমে জন-আস্থা বাড়বে।

চ্যালেঞ্জ : তবে আইন থাকলেই সব সমাধান হবে না। এর চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে- বাস্তবায়নক্ষম জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো। দুর্নীতি, ভূমি দখল ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকাও নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক ও অংশীজনদের পরামর্শ ও অংশগ্রহণ কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন হবে।

মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার রাজউকের সংস্কারের ব্যাপারে কমিটেড। রাজউককে কার্যকরভাবে সংস্কার করার জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের মতো এর নীতিনির্ধারণী বোর্ড এবং রাউকের বাস্তবায়নকারী কর্তপক্ষ আলাদা করারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে রাজউকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ করে বাইরে কেউ চেয়ারম্যান হতে পারেন। রাজউকের নিজস্ব জনবলের জন্য সদস্যের নিচের পদ পর্যন্ত নির্ধারিত থাকবে। তিনি উল্লেখ করেন- নভেম্বর ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কারের বিষয়টি চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। সংস্কারের পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৫ কেবল একটি আইন হবে না; এটি বাংলাদেশের নগরব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় একটি যুগান্তকারী নীতি কাঠামোতে রূপ নিতে পারে। এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে পরিবেশবান্ধব, টেকসই, পরিকল্পিত ও নাগরিকবান্ধব মহানগরীতে রূপান্তর করা সম্ভব হবে।