মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকালীন জীবিকা সুরক্ষায় ন্যায্য সহায়তা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি দাবি জানিয়েছে ভোলার ুদ্র জেলে সম্প্রদায়।
বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার জন সরাসরি ইলিশ মাছ ধরার সাথে যুক্ত আছেন, যার মধ্যে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত জেলেরা অন্তভুক্ত। এই মাছ ধরা কার্যক্রমে প্রত্য ও পরোভাবে যেমন মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বিপণন ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ নারী ও পুরুষ জড়িত। তারা প্রত্যেকেই ইলিশ মাছ থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। মাছের প্রজনন রায় প্রতি বছর সরকার কয়েক দফা নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা পরিবেশগতভাবে অপরিহার্য ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক। কিন্তু এই সময়টিতে ক্ষুদ্র জেলেরা সম্পূর্ণভাবে আয়ের উৎস হারান। তারা মাছ ধরতে পারেন না, বাজারে যেতে পারেন না, বিকল্প পেশা বা সামাজিক সুরা নেই। ফলে এই জেলে পরিবারগুলো খাদ্য অনিরাপত্তা, ঋণগ্রস্ততা, সামাজিক মর্যাদাহানি ও পারিবারিক ভাঙনের মুখে পড়ে। তাই তারা ন্যায্য সহায়তা ও বিকল্প আয়ের সুযোগ চেয়েছেন।
কোস্ট ফাউন্ডেশন, ২০২৪ এবং ২০২৫ সালের সংগৃহীত তথ্য ও কাস্ট ৮০০৪ তথ্য স্থানীয় অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, এই অবস্থানপত্রে ভোলার ক্ষুদ্র জেলেদের বাস্তব চিত্র, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক নীতির সংযোগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বর্তমান প্রোপট : বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
২০২৩-২৪ সালে, ৪৭ লাখ হেক্টর জলাশয়ে মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২৯ লাখ ৭৮ হাজার টন মাছ ছিল চাষের, ১৪ লাখ ১১ হাজার টন মাছ আহত হয় উন্মুক্ত জলাশয় থেকে, আর বাকিটা সংগ্রহ করা হয় সমুদ্র থেকে। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরিত মাছের অর্ধেকই ইলিশ। জাতীয় মৎস্যনীতি এবং সামুদ্রিক মৎস্য আইন এই খাতকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে এসব নীতিমালা ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জন্য নিরাপদ অধিকার, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের “ঝসধষষ-ঝপধষব ঋরংযবৎরবং এঁরফবষরহবং (ঝঝঋ-এঁরফবষরহবং)” স্বারকারী দেশ, যা ক্ষুদ্র জেলেদের সামাজিক সুরা, সম-অধিকার ও জীবিকা নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব জোরদার করার আহ্বান জানায়। একই সাথে ইষঁব ঊপড়হড়সু, ঝউএ-১৪ (‘খরভব ইবষড়ি ডধঃবৎ’), এবং ঘউঈ-তেও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও জীবিকাগত অভিযোজনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
তবে বাস্তবতা বলছে, প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও ক্ষুদ্র জেলেদের জীবিকা-সঙ্কট সমাধানের কার্যকর কাঠামো এখনো দুর্বল। ডঞঙ এর ঋরংযবৎরবং ঝঁনংরফু অমৎববসবহঃ, ঈঙচ৩০-এর ‘ঔঁংঃ ঞৎধহংরঃরড়হ’ নীতিমালা, কিংবা জাতীয় ইষঁব ঊপড়হড়সু কর্মপরিকল্পনা, সব জায়গাতেই ক্ষুদ্র জেলেরা আলোচনার বাইরে রয়ে গেছেন।
এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো বিশেষ করে মাছকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে অনাকাক্সিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মাছ ধরার নৌকাগুলো আশানুরূপ মাছ ধরতে পারছে না। এ জন্য তাদেরকে বিভিন্ন তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
পাশাপাশি উপকূলজুড়ে অবৈধ জালের অবাধ ব্যবহার নদী ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে উঠছে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত উপকূলীয় জেলে পরিবারগুলো বাড়তি আয়ের জন্য এবং ঋণনির্ভরতার কারণে ৩০-৩৫ শতাংশ জেলে পরিবার অবৈধ/নিষিদ্ধ জাল [কারেন্ট জাল, মশারি, প্লাস্টিক জাল, বিন্দি, ঠেলা, খুটা জাল ইত্যাদি। ব্যবহার করছে। কোস্টের ২০২৫ সালের এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, ৯৩ শতাংশ জেলেই জানেন যে, এর ফলে নদীর ও সাগরের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকহারে তিগ্রস্ত হচ্ছে এবং মাছের উৎপাদন ও প্রজনন প্রক্রিয়া হ্রাস পাচ্ছে। তার পরেও বেঁচে থাকার তাগিদে তাদেরকে এই কাজ করতে হচ্ছে। এই সব জালে প্রয়োজনীয় মাছ ধরার পাশাপাশি নানা প্রজাতির মাছের পোনা নির্বিচারে মারা যাচ্ছে, মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত শৈবাল, অতিক্ষুদ্র জলজ প্রাণীসহ নানাবিধ প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
শিল্প সম্প্রসারণ/এক্যুয়াকালচার, চিংড়ি চাষ এবং পর্যটনের নামে ভূমি/খাস জমি দখলের কারণে দূষণ বাড়ছে, পলি পড়া, ডুবোচর, যার ফলে ইলিশের গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ও নার্সারি আবাসস্থলগুলোর ধ্বংস হচ্ছে। এই ইকো-আবাসস্থলগুলো এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো জীববৈচিত্র্যের তি এবং প্রাকৃতিক প্রজনন চক্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ এবং উপকূলীয় মৎস্যসম্পদ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ফলে গত পাঁচ বছরে ইলিশ উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে; ২০২৩-২৪ সালে যা ছিল সবনিম্ন ৫.২৯ লাখ টন।
ক্ষুদ্র জেলেরা প্রায়ই তারা যে মাছ ধরেন, সেগুলো পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ ও রণাবেণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তাদের কাছে নেই বা তাদের সেখানে এক্সেস নেই। যার ফলে তাদের পণ্যের গুণগত মান এবং লাভ কমে যায়। ফলে তারা স্বল্পমূল্যে জেলেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে, তাদের মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হন।
বড় বিষয় হচ্ছে, জাতীয় জিডিপিতে ইলিশের ১ শতাংশের বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও, এই মাছ ধরার সাথে সম্পৃক্ত ক্ষুদ্র জেলে সম্প্রদায় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে উপেতি থাকেন, যেখানে সরকার পরিচালিত মৎস্য নীতি আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। এর কারণে নীতিমালাগুলো ক্ষুদ্র জেলেদের চাহিদা যেমন নিরাপদ অধিকার, টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় ঐতিহ্য ও রীতিনীতির সংরণ- এসব বিবেচনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ভোলার জেলে পরিবারগুলোর বাস্তব চিত্র
ভোলা জেলা মোট নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার জন (উড়ঋ, ২০২৫)। এর প্রায় ৮১ হাজার জেলে পরিবার এখরনা সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না। তবে ইউনিয়নভিত্তিক তথ্য থেকে দেখা সায়, প্রকৃত ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অন্তত ২০ হাজারের বেশি এখনো সরকারি নিবন্ধনের বাইরে আছেন। শুধু ভোলা সদর উপজেলায় প্রকৃত ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার জন। এর মধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ পরিবার জেলে কার্ডধারী। বিজ্ঞপ্তি।



