চতুর্মুখী জঞ্জালে আবদ্ধ ঢাকাবাসী

আবুল কালাম
Printed Edition

চতুর্মুখী জঞ্জালে আবদ্ধ ঢাকাবাসী। বিশৃঙ্খল নগরীতে ঘর থেকে বের হলেই ভোগান্তি। এক কোটি মানুষের নাগরীতে বাস করছে প্রায় আড়াই কোটি। প্রতি বর্গমাইলে সোয়া লাখ আর প্রতি একর আয়তনে ১২০ জন মানুষের পরিবর্তে বাস করে ৮০০ জন। দিনে মানুষ বাড়ছে দেড় হাজার করে। যানবাহন চলছে ধারণক্ষমতার ৬ গুণ বেশি। তীব্র যানজট আর দখল হওয়া ফুটপাথে হেঁটে চলাও কঠিন। ক্রমাগত দখল দূষণে জলাধার ও সবুজায়ন ধ্বংসে নাজুক হয়ে উঠছে পরিবেশ। যানজট, খোঁড়াখুঁড়িতে ধুলায় ধূসর নগরীতে মাস্ক পরেও চলা দায়। কয়েক বছরের ব্যবধানে ভরাট হয়ে গেছে খাল-নালা-জলাশয়। ময়লার স্তূপে নাকচেপে চলছে পথচারী। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় অচল হয়ে পড়ছে সড়ক। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতায় পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, ভয়াবহ যানজট, পয়োনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এতে করে কয়েক বছর ধরে বায়ু আর শব্দ দূষণে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম। বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়ও ঢাকার অবস্থান সামনের সারিতে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিগত প্রায় ৯ বছরে অর্থাৎ ৩২৪০ দিনে ঢাকা দূষণমুক্ত ছিল মাত্র ৬০ দিন। বাকি ৩ হাজার ১৮০ দিন দূষণে নগর ছিল বসবাসের অযোগ্য। অথচ নগরীর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকে বসবাসের সহায়ক রাখতে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদফতর থাকলেও বাস্তবে তারা এর কার্যকর ব্যবস্থায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বাতাসে উচ্চমাত্রায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানের অস্থিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে রয়েছে- আর্সেনিক, সিসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান। ঢাকার বাতাসে এসব বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ বলে নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে।

গবেষণায় ঢাকা শহরের বাতাসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন আরেকটি উপাদান কোবাল্টের উচ্চ মাত্রায় উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বের ২৭টি স্থানে পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি এবং ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্প, কয়লাভিত্তিক ইটভাটা এবং যানবাহনগুলো রাসায়নিক উপাদানগুলোর উচ্চ ঘনত্বের জন্য দায়ী। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-ই একমাত্র স্থান যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ের ক্যানসার সৃষ্টির ঝুঁকি মানদণ্ড ছাড়িয়েছে। যার ভেতর বসবাস করছে রাজধানীর মানুষ।

অন্য দিকে কর্মঘণ্টার বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়, যানজটের কারণে রাজধানীতে পরিবহন প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সবমিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি। এ ছাড়া সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনকে যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে দেখা যায়।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর পরিবেশ রক্ষায় ঢাকায় ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান তা ১২ শতাংশ কমে প্রায় ৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। বছরে ৩ বর্গমিটার করে কমছে ফাঁকা জায়গা। উত্তাপ বাড়ছে প্রায় এক শতাংশ করে এলাকায়। অসহনীয় বায়ু দূষণের সাথে তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়াচ্ছে।

সবুজ আন্দোলন তথ্য ও গবেষণা পরিষদের সমীক্ষা অনুযায়ী- ২০০০ সাল থেকে ঢাকা শহরের প্রায় ৭০ ভাগ পাকা ঘরবাড়ি আচ্ছাদিত ছিল। ২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮৩ ভাগ। বিগত সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৫ ভাগ থেকে কমে ৬ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। তবে সবুজায়ন বেড়েছে ৫ ভাগ।

অপর দিকে জলাবদ্ধতা নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, ৫৪ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টির পানি নগরী থেকে নিষ্কাশন সম্ভব। এর বেশি নিষ্কাশনের সক্ষমতা ঢাকা শহর অনেক আগেই হারিয়েছে। ফলে সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই নগরী পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তবে সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, তারা এর নিরসনে তৎপর রয়েছেন। ইতোমধ্যে খাল উদ্ধারে এবং অবৈধ দখলমুক্ত করতে একাধিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে।

মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে ঢাকা শহরের রাস্তায় দৈনিক দুই লাখ গাড়ি চলাচলের সক্ষমতা আছে, কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে ১২ লাখ। অর্থাৎ রাজধানীতে ধারণক্ষমতার চেয়েও প্রায় ছয়গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করছে। ফলে যানজট লেগেই থাকছে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীর মধ্যে ১০ থেকে ২০ নাম্বারের মধ্যে ঢাকার অবস্থান। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শহর থেকে মানুষ ঢাকায় এসে স্থায়ী হচ্ছে। তাদের আবাসনে রাজধানীতে প্রতি বছর উঁচু ভবন বাড়ার সাথে ঢাকার ওপর প্রতিদিন নতুন করে চাপ বাড়ছে। কারণ এসব বড় বড় একেকটি ভবনে একেকটা গ্রামের সমপরিমাণ লোক বাস করে। এতে পরিবেশ দূষণ, শব্দদূষণ, পয়োনিষ্কাশন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকা একটা বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতিতে পড়েছে। ফলে ৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।

অন্য দিকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: খালিদ হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেই এমনটা হয়েছে। যেকোনো পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কেউ নিয়ম মানছে না। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক নেই। খালগুলো দখল হয়ে গেছে। আসল কথা হলো জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তবেই নগরবাসীর মুক্তি মিলবে।

এ দিকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, দূষণ সব সময়ই উদ্বেগের। কিন্তু যেসব কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে তার উৎস বন্ধ না হলে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে না। ফলে ধাপে ধাপে শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ না করে স্বল্প সময়ে কার্যক্রম নিয়ে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত। তাতে করে এক সময় পরিবেশ রক্ষায় সফলতা আসবে।