কোথায় দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক সমীকরণ?

একই কাতারে যাচ্ছে গণ অধিকার পরিষদ ও এনসিপি

নানা গুঞ্জনের মধ্যেই এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে তরুণদের নেতৃত্বাধীন দু’টি রাজনৈতিক দল, গণ অধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একটি জোট গঠন হতে পারে। আবার দুই দল মিলে একটিতেও রূপান্তর হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। দু’টি বিষয়কে সামনে রেখেই চলছে আলোচনা।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
এনসিপি ও গণ অধিকার পরিষদের লোগো
এনসিপি ও গণ অধিকার পরিষদের লোগো |ইন্টারনেট

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই সরগরম হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। পুরনো জোটের ভাঙা-গড়া এবং নতুন মেরুকরণের নানা গুঞ্জনের মধ্যেই এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে তরুণদের নেতৃত্বাধীন দু’টি রাজনৈতিক দল, গণ অধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একটি জোট গঠন হতে পারে। আবার দুই দল মিলে একটিতেও রূপান্তর হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। দু’টি বিষয়কে সামনে রেখেই চলছে আলোচনা। দলগুলোর একাধিক সূত্রের দাবি, এটি কেবল গুঞ্জন নয়, বরং দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ে এ নিয়ে কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে। যদিও নেতারা এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোনো সিন্ধান্তে পৌঁছাননি, তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নভেম্বরের মধ্যেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধন্ত আসতে পারে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আলোচিত এই দল দু’টি একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সফল হলে তা দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সমীকরণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দুদলেরই নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আলোচিত তরুণদের নিয়ে গঠিত এই দুই দলকে ঘিরে রাজনৈতিক মহলে বেশ কিছুদিন ধরেই কানাঘুষা চলছিল যে, তরুণদের একক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার একটি চেষ্টা চলছে।এ আলোচনার পালে নতুন করে হাওয়া লাগে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আহত গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে হাসপাতালে দেখতে যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ শীর্ষ নেতারা। তখন থেকেই দুই দলের মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে একীভূতকরণের কথাবার্তা শুরু হয়।

এ ব্যাপারে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান জানান ‘আমাদের দলের মূল ভিত্তি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন। সে সময় আজকের এনসিপির অনেক নেতাকর্মীই আমাদের সাথে ছিলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আরো জোরদারের লক্ষ্যেই আমরা নতুন পথচলা শুরু করতে চাই। আমরা মনে করি, এতে তারুণ্যের শক্তি আরো বেগবান হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে কিভাবে একসাথে কাজ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’

অন্য দিকে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, ‘গণ অধিকার পরিষদ ও এনসিপির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই তরুণ। কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে বিগত জুলাই আন্দোলনেও আমরা একসাথে রাজপথে ছিলাম। সেই হিসেবে দুই দলের অনেক কাজেরই মিল রয়েছে। তাই আমাদের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, এতে তারুণ্যের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হবে।’

যদিও এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার কথা গণমাধ্যমের নিকট অস্বীকার করেছেন, তবে তিনি বলেছেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাথে আমাদের একসাথে কাজ করার চিন্তা রয়েছে।’ এই ‘একসাথে কাজ করার চিন্তা’ থেকেই মূলত একীভূত হওয়ার বিষয়টি আসছে।

কেন এই একীভূতকরণের প্রচেষ্টা?

এনসিপি এবং গণ অধিকার পরিষদ দুই দলেরই রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি এবং উত্থানের প্রেক্ষাপট প্রায় একই। উভয় দলেরই জন্ম হয়েছে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম গণ অধিকার পরিষদের, আর ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ বা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত হয় এনসিপি। এই অভিন্ন উৎসের পাশাপাশি দুই দলের নেতৃত্বের মধ্যেও একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র বিদ্যমান। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ অনেক নেতাই রাজনৈতিকভাবে নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন। আখতার হোসেন ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে নুরের প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উভয় দলের নেতারাই মনে করেন, দেশের তরুণ সমাজ একটি একক ও শক্তিশালী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দেখতে চায়। গত এক দশকে যারা বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, তাদের পক্ষ থেকেই এই ঐক্যের দাবি উঠছে।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা একটা মধ্যপন্থী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বাংলাদেশে যারা মধ্যপন্থী রাজনীতির সাথে একাত্মতা অনুভব করে, তাদের যে কারও এনসিপির সাথে যুক্ত হওয়াকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখি।’

সূত্রমতে, দুই দল একীভূত হলে এর নাম ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। নেতৃত্বে একটি ভারসাম্য আনার জন্য ১০ সদস্যের একটি শীর্ষ পর্ষদ গঠনের প্রস্তাবনা আলোচনায় এসেছে, যেখানে উভয় দল থেকে পাঁচজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। এই পর্ষদই দলের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে। নেতৃত্বের শীর্ষে এনসিপির বর্তমান আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের থাকার সম্ভাবনা প্রবল। অন্য দিকে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদ অথবা একটি সম্মানজনক পদে রাখার আলোচনা চলছে। এ ছাড়াও আখতার হোসেনের মতো গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বকেও সামনে রাখা হবে বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির একজন নেতা নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘গণ অধিকার পরিষদ এনসিপিতে যোগ দিতে চায়, এমন একটা আলাপ আমাদের মধ্যে আছে। আমরা নিজেদের ফোরামে কথা বলছি, তাদের সাথেও কথা বলছি। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’

একীভূত হওয়ায় পরে যে চ্যালেঞ্জ থাকবে : বিশ্লেষকদের মতে এই একীভূতকরণের পথটি একেবারে মসৃণ নয়। বিশেষ করে সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে এনসিপির ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ (বাগছাস)-এর প্যানেলের ভরাডুবি দলটির জন্য একটি বড় ধাক্কা। তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এই পরীক্ষায় ব্যর্থতা এনসিপির সাংগঠনিক দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যারা জিতেছে তাদের সংগঠন সুসংগঠিত ছিল। এটা মানতে হবে যে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এখানে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা তৃণমূল থেকে সংগঠনকে সুসংগঠিত করায় মনোযোগ দিচ্ছি।’

তিনি মনে করেন, “এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না, বরং এটি তাদের জন্য একটি ‘বার্তা’ যা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবেন।”

অন্য দিকে গণ অধিকার পরিষদ ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করেছে, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। পক্ষান্তরে, এনসিপির নিবন্ধন এখনো প্রক্রিয়াধীন। তবে নতুন যে ছয়টি দল নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে তার মধ্যে এনসিপিও রয়েছে।

রাজনৈতিক সমীকরণে কী প্রভাব পড়বে?

যদি এই দু’টি দল সফলভাবে একীভূত হতে পারে, তবে তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এই জোট তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশকে আকৃষ্ট করতে পারে, যারা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বীতশ্রদ্ধ। এর মাধ্যমে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক শিবিরের বাইরে একটি নতুন, তারুণ্যনির্ভর ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ধারা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে- এই নতুন দলটি। বিশেষ করে, যে বিপুলসংখ্যক মানুষ দু’টি প্রধান দলের বাইরে নতুন কিছু খুঁজছে, তাদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এ ছাড়াও দু’টি দলেরই রাজপথের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। একীভূত হলে সরকার বা যেকোনো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে তাদের দর-কষাকষির ক্ষমতাও নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে।

গণ অধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসানের কথায় এই সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে তো অনেক কিছুই সম্ভব। আমরা তারুণ্যের শক্তিগুলো এক হওয়ার চেষ্টা করছি।’

সাধারণ সম্পাদক রাশেদ বলেন, ‘আমরা একীভূত হলে রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এতে যারা বাধা দেবে তাদের রাজনীতিই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’

বিশেষজ্ঞদের মত, গণ অধিকার পরিষদ ও এনসিপির একীভূত হওয়ার আলোচনা আরেকটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো এবং কিছু মৌলিক বিষয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা এখনো বাকি, তবে উভয় দলের নেতাদের ইতিবাচক মনোভাব একটি সফল পরিণতির দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোই বলে দেবে, তারুণ্যের এই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শেষপর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কি না এবং দেখলে তা কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে জাতীয় রাজনীতিতে। দেশের মানুষ এখন সেদিকেই তাকিয়ে আছেন।