বিএনপির শরিকরা আসন বণ্টনের সুরাহার অপেক্ষায়

দলীয় প্রার্থিতার পাশাপাশি জোটের জন্যও আসন রেখেছে বিএনপি। কিন্তু প্রায় এক মাস হতে চললেও ফাঁকা আসনগুলোতে কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে আগেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে, চলতি মাসের মধ্যেই ফাঁকা আসনগুলোতে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হবেন, তা জানিয়ে দেয়া হতে পারে। এমন অবস্থায় জোটের শরিকরা বিএনপির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

শিগগিরই আসন বণ্টনের সুরাহা চায় বিএনপির শরিকরা। ২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশী শীর্ষ নেতারা এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। কেউ কেউ হতাশাও প্রকাশ করেছেন। নেতারা বলছেন, দ্রুত বিএনপির হাইকমান্ড থেকে তারা মনোনয়নের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চান। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির সাথে যাতে কোনো মনোমালিন্য তৈরি না হয়, সেজন্যই এই ঘোষণা জরুরি।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিএনপি মহাসচিবসহ দায়িত্বশীল নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন শরিক দলগুলোর নেতারা। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন। জোটের শরিকরা এখন তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের অপেক্ষায় রয়েছেন।

গত ৩ নভেম্বর ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি। বাকি ৬৩ আসন তখন ফাঁকা রাখা হয়। এখানে দলীয় প্রার্থিতার পাশাপাশি জোটের জন্যও আসন রেখেছে বিএনপি। কিন্তু প্রায় এক মাস হতে চললেও ফাঁকা আসনগুলোতে কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে আগেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে, চলতি মাসের মধ্যেই ফাঁকা আসনগুলোতে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হবেন, তা জানিয়ে দেয়া হতে পারে। এমন অবস্থায় জোটের শরিকরা বিএনপির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তারা প্রত্যাশিত আসনে গণসংযোগ চালিয়ে গেলেও বিএনপির তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু নিশ্চিত না করায় তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন, হতাশায় ভুগছেন। এতে করে জোট শরিকরা পূর্ণ উদ্যোমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারছেন না। পাশাপাশি প্রতিটি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারাও সক্রিয় রয়েছেন, তারাও ক্যাম্পেইন করছেন। ফলে এসব আসনে দলীয় না জোট থেকে প্রার্থী করা হবে, তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে একই সাথে নির্বাচন ও সরকার গঠন করার অঙ্গীকার রয়েছে বিএনপির। নির্বাচন সামনে রেখে আসন বণ্টন বা আসন সমঝোতা প্রশ্নে বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী যুগপতের প্রায় সব মিত্রই এরই মধ্যে তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির কাছে ১৬৮ জনের প্রার্থী তালিকা জমা দিয়েছে যুগপতের শরিকরা। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ব্যতীত ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের বাকি পাঁচ দল ৪০ জন, ১২ দলীয় জোট ২১ জন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ৯ জন, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ১৯ জন, এলডিপি ১৩ জন, গণ অধিকার পরিষদের ২৫ জন, গণফোরাম ১৬ জন, এনডিএম ১০ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) পাঁচজন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ছয়জন এবং বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি)) চারজনের প্রার্থী তালিকা দিয়েছে। তবে তালিকা জমা নেয়ার পর শরিকদের কারো সাথে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসেনি বিএনপি।

জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম বলেন, বিএনপির সাথে আসন বণ্টন বা আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। এটা নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে ভার্চুয়ালি বৈঠক করবেন, বিষয়টি এমন একটা অবস্থার মধ্যে আছে। আমরা ধারণা করি, দ্রুতই মঞ্চের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো: রাশেদ খান বলেন, বিএনপির সাথে গণ অধিকার পরিষদ ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করেছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের সাথে গণ অধিকার পরিষদের ইতিবাচক আলোচনা চলছে। এ ছাড়া আরো অন্য দলের পক্ষ থেকেও জোট গঠনের ব্যাপারে গণ অধিকারকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করি, নির্বাচনের তফসিলের পর এ ব্যাপারে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

জানা গেছে, গণফোরামের জন্য ঢাকা-৭ ও নরসিংদী-৩ আসন ছাড় দিতে পারে বিএনপি। যেখানে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও জগলুল হায়দার আফ্রিক। ২০১৮ সালে গণফোরামকে সাতটির মধ্যে ঢাকা ৬ ও ৭ আসনও ছেড়েছিল বিএনপি। সেবার সুব্রত চৌধুরী ঢাকা-৬ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। এবারো বিএনপির কাছে তার জন্য এই আসন চেয়েছে গণফোরাম।

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে দুইটি আসন দেয়া হতে পারে। পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী থাকায় নুরকে ঢাকা থেকেও কোনো আসন দেয়া হতে পারে। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ঢাকা-৫ এর কথা বলেছেন। এই আসনে পটুয়াখালী জেলার বহু মানুষের বসবাস রয়েছে। রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ থেকে একটি আসন দেয়া হবে।

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে প্রার্থী হতে পারেন এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব:) অলি আহমদ বা তার বড় ছেলে ওমর ফারুক। অলি এবার নির্বাচন নাও করতে পারেন। আর কুমিল্লা-৭ আসনে লড়বেন দলের মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-৩ আসনটি প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. জেনারেল (অব:) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর জন্য চেয়েছে এলডিপি। ফাঁকা রয়েছে এ তিনটি আসন।

এ ছাড়া পিরোজপুর-১ আসনে সবুজ সঙ্কেত পেয়েছেন ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং ঢাকা-১৭ আসনে বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি। এ তিনটি আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি।

লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে লড়বেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাও গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বিএনপির কাছে এই আসনটি চেয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূমও। এ দু’টি আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি।

এ ছাড়া ঢাকা-১৩ আসনে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ সবুজ সঙ্কেত পেয়েছেন। এসব আসনে বিএনপি কাউকে প্রার্থী করেনি।

খালি আছে ঝালকাঠি-১ আসনও। এ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। একইভাবে ফাঁকা রাখা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন জমিয়তের সহসভাপতি ও হেফাজত নেতা জুনায়েদ আল হাবিব। বিএনপির কাছে জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব রশিদ বিন ওয়াক্কাসের জন্য যশোর-৫ আসনটি চেয়েছে ১২ দলীয় জোট। এ আসনটিও খালি রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে এরই মধ্যে সবুজ সঙ্কেত পেয়েছেন ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, আমাকে অনেক আগেই মৌখিকভাবে কাজ করার জন্য বিএনপির উচ্চমহল থেকে সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। আমি নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে শেষ পর্যন্ত বিএনপির সমর্থন আমার ওপর থাকবে।

এ দিকে গণতন্ত্র মঞ্চ জোট শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের জন্য ঢাকা-৮ আসন নিয়ে বিএনপির সাথে সমঝোতা চাইলেও প্রধান শরিক বিএনপি এ আসন থেকে এরই মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে প্রার্থী করেছে। জানা গেছে, এ অবস্থায় সাইফুল হকের জন্য ঢাকা-১২ আসনটি চাইতে পারে মঞ্চ, যদিও এ আসন থেকে সাইফুল আলম নীরবকে প্রার্থী করেছে বিএনপি।

বিএনপি সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেবার শরিকদের জন্য ৫৯টি আসন ছাড়লেও এবার তাদের জন্য ২০-২৫টি আসন ছাড়ার কথা ভাবছে দলটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতকেই বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থিতা এবং সংশোধিত আরপিও বিবেচনায় নিয়ে মূলত বিজয়ী হওয়ার মতো শরিকদের ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আসন ছাড়বে বিএনপি। তাই শরিকদের জন্য আসন ছাড়ের সংখ্যাও কমতে পারে। কারণ মিত্রদের জন্য ছাড়া আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী বিজয়ী হোক, সেটা চায় না বিএনপি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বাইরেও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এবং কয়েকটি ইসলামী দলকেও নির্বাচনী জোটে নিতে আগ্রহী। এর অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু আসন খালিও রেখেছে দলটি। তবে এ বিষয়ে এখনো সুস্পষ্ট কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় এসব আসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বিএনপি। সে কারণে মিত্রদের আসন বণ্টনের ব্যাপারটিও ঝুলে রয়েছে।

জানা গেছে, এনসিপির ব্যাপারে কারো কারো আগ্রহ থাকলেও দলীয়ভাবে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিএনপি। তারা যদি বিএনপি জোটে কিংবা বিএনপির সাথে আসন সমঝোতায় আসতে চায়, তাদের শীর্ষ নেতাদের কয়েকটি আসন দেয়া হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের দু’জন ছাত্র উপদেষ্টা বিএনপি থেকে কিংবা বিএনপির সমর্থনে নির্বাচন করতে চান বলে বিএনপির কেউ কেউ জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে কোনো সুরাহা হয়নি। এ ছাড়া আসন ছাড়ের ক্ষেত্রে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ব্যাপারটিও ভাবাচ্ছে বিএনপিকে। আগে কোনো দল জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে তারা জোটের শরিক যেকোনো দলের প্রতীক নেয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে। এটাও বিএনপির একটা উদ্বেগের জায়গা। দলটির কেউ কেউ মনে করেন, মিত্ররা যদি ধানের শীষের প্রতীকে নির্বাচন করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে তাদের বিজয়ী হওয়া কঠিন হতে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের কিছু আসন ছেড়ে দেয়া হবে বলে শুনেছি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এটা নিয়ে কাজ করছেন। তিনিই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।