গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতিমান শিক্ষক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হিসেবে ড. ওয়ালিদ কাসসাবের মর্যাদা রয়েছে। মর্যাদা রয়েছে বিশ্ব-ইসলামী সাহিত্যের একজন শক্তিধর প্রবক্তা হিসেবে। ড. ওয়ালিদ কাসসাব সাহিত্যের নিরলস সাধকও। কুরআন এবং হাদিসের আলোকে সাহিত্যের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে তার রয়েছে অগাধ পাণ্ডিত্য। অপরিসীম দরদ আর মমতায় ওই বিষয়ে ক্রমাগত লিখেও চলেছেন তিনি।
ড. কাসসাবের একটি অমূল্য সংগ্রহ হচ্ছে- সাহিত্য সম্পর্কিত ৪৬টি বাণী। এই অসাধারণ সংগ্রহের অনুবাদ করেছেন সালাম আজাদী। ড. কাসাবেরই সুযোগ্য ছাত্র। ৪৬টি বাণী থেকে নির্বাচিত ক’টি এখানে-
১. কবিতা হলো সুসংবদ্ধ কথামালা।
২. কবিতা ও সাধারণ কথাবার্তার বিচার একই নিক্তিতে হতে হবে। অনাবিল এবং পরিমল কথাবার্তার যে মূল্য, শ্লীল কবিতারও সেই মূল্য। অশ্লীল বক্তব্য যেমন অপ্রীতিকর, অশ্লীল কবিতাও তেমন।
৩. আরবদের সুসংবদ্ধ কথা হলো তাদের কবিতা। কবিতার ভাষায়- তাদের কাছে কিছু চাইলে তারা মন ভরে দান করে। তাদের রোষের আগুন নির্বাপণ করে কবিতার অন্তঃসলিল প্রবাহ। সাহিত্য-বাসরে কবিতাই হলো তাদের জন্যে মনোহর উপঢৌকন।
৪. যে দুটো মনোরম আভরণে কোনো বিশ্বাসীকে আল্লাহ সাজিয়ে থাকেন, কবিতা তার একটি।
৫. উট থামাতে পারে তার সকরুণ ক্রন্দন। কিন্তু আরবরা তাদের কবিতার সুর থামাতে পারে না।
৬. মহানবী সা: মসজিদে হাসসানের জন্য উঁচু মিম্বার তৈরি করিয়ে নেন। তার ওপরে চড়ে হাসসান নবীজির গৌরবগাথা এবং মুশরিকদের নিন্দাকাব্য আবৃত্তি করত। কখনো মহানবী সা: বলতেন, হাসসানের জিভ যতদিন রাসূলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, ততদিন তার সাথে জিবরাইল থাকবেন।
৭. আমর বিন আশশারিদ একবার মহানবী সা:-এর পেছনে বাহনে বসে চলছেন। মহানবী সা: জিজ্ঞেস করলেন, আশশারিদ, উমাইয়া বিন আবুসসালতের কোনো কবিতা তোমার জানা আছে কি? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ আছে জনাব, বলব? নির্দেশ এলো, বলো তো শুনি। আশশারিদ বলেন, আমি একটি পঙ্ক্তি শুনালাম। তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে বললেন, আরো আরো। আমি আরো শুনালাম। তিনি আরো বেশি শুনতে চাইলেন। আমি শ’খানেক পঙক্তি আবৃত্তি করে শুনালাম। উমাইয়ার কবিতা শুনে মহানবী সা: মাঝে মধ্যে বলতেন, উমাইয়া তো প্রায় মুসলিম হয়ে গিয়েছিল। উমাইয়ার কবিতা সমালোচনায় মহানবী সা: বলেছেন, তার কবিতা ঈমান এনেছে, অথচ মন এখনো কুফরির তমসায়।
৮. ইবনে রাওয়াহার কবিতা শুনে রাসূল সা: বলতেন, তোমাদের ভায়ের কবিতা দেখো-কত অনাবিল এবং পরিচ্ছন্ন।
৯. কবিদের আর্থিক সহযোগিতা দান করা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সমতুল্য।
১০. হুনায়ন যুদ্ধে প্রাপ্তসম্পদ মহানবী সা: ভাগ করে দিচ্ছিলেন, আব্বাস বিন মিরদাসকে দিলেন চারটি বলিষ্ঠ উট। এতে মন ভরল না তাঁর। অনুযোগের স্বরে [কবিতায়] বললেন,
- কোনো দিনও বধ্যভূমি ও কেল্লা সব
- ঘাড় ভাঙতে পারেনি কো মিরদাসের
- আমিও কভু পিছে ছিলাম তেমন তো নয়
- আজকে যদি হইগো নিচু উঠাবে ফের
- সে লোক কোথায়?
- কবিতা শুনে মহানবী সা: বললেন : ওরে, কেউ কি কবি সাহেবের মুখ বন্ধ করতে পারো? আবু বকর তাকে নিয়ে গেলেন। বেছে বেছে ১০০ উট নিয়ে নিতে দিলেন তাকে। খুশিতে ডগমগ হলেন কবি।
১১. ইসলাম গ্রহণের পরেও যে অশ্লীল কাব্য ছাড়তে পারল না, সে যেন তার জিভটাই নষ্ট করে ফেলল।
১২. আল আসওয়াদ বিন সারি বলেন, আমি কবি ছিলাম। একবার মহানবী সা:-এর কাছে এসে বললাম, আমার রবের স্তুতি গেয়ে আমি কিন্তু কবিতা লিখেছি। ইয়া রাসূলুল্লাহ তা থেকে কিছু শোনাব? তিনি বললেন, তোমার রব এ ধরনে স্তুতি নিশ্চয়ই পছন্দ করেন।
১৩. একবার মহানবী সা: হাসসানকে জিজ্ঞেস করলেন, বললেন, আচ্ছা, আবু বকরকে নিয়ে কোন কবিতা কি এ পর্যন্ত লিখেছো, হাসসান? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ লিখেছি কিছু। বললেন, কই, শোনাও তো দেখি। কবি বলতে বলাতে পৌঁছলেন-
- সুউচ্চ সাওর গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি সে তিনিই
- [যখন] রক্ত লোলুপ শৃগালেরা শুঁকে শুঁকে
- শিখরে এলো। রাসূল পিছে আছেন সদা মায়াবিনী ছায়াত
- সবাই জানে নবীর পরে তিনিই হলেন সৃষ্টি-সেরা।
- শুনে মহানবী খুবই হাসলেন। বললেন, ঠিক বলেছো হাসসান, যা বলেছো তার যোগ্য তিনিই।
১৪. রাসূল সা: প্রখ্যাত মহিলা কবি খানসা রা:-এর কবিতা বেশ পছন্দ করতেন। মাঝে মধ্যে তার কাছে কবিতা শুনতে চাইতেন। হাতের ইশারা দিয়ে বলতেন, ‘খুনাস শোনাও তো দেখি’।
১৫. মুসলমানরা কুবার মসজিদ বানাতে ব্যস্ত। ইবনে রাওয়াহার রচিত (জারি গানের মতো এক ধরনের গান) গাচ্ছে তারা।
- পুণ্য পথের পান্থরা গড়ে এ-মসজিদ
- কুরআন পড়ে দাঁড়িয়ে-বসে। যায় না নিদ।
- শক্ত আঘাতে পাথর ছুটছে দিগি¦দিক।
- রাসূল কারিম সা:-ও তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাচ্ছেন। পঙক্তির শেষের শব্দ ধরে সুর মিলাচ্ছেন তিনি।
১৬. দীর্ঘ সফরে রাসূল সা: চলছেন মরুপথ ধরে। রাত হয়েছে বেশ। বললেন, হাসসান কোথায়? এগিয়ে এলেন হাসসান। বললেন, লাব্বায়েক জনাব, এই তো আমি। মহানবী বললেন, হাসান আমাদের কিছু ‘হুদা’ শুনাও তো। শুরু করলেন কবি। ওদিকে মহানবী শুনে চলছেন, নিরবচ্ছিন্নভাবে। উট চলছে অধিকতর ক্ষিপ্রতায়।
- এ সময় (উটের দ্রুত চলার কারণে। হাওদা যেন পেছন দিয়ে পড়ে যায়। গান থামাতে বললেন মহানবী। তারপর বললেন, ‘কবিতাকে এ জন্য বলা হয়, ‘বিদ্যুতের চে’ দ্রুত সঞ্চারক এবং এর আঘাত শেলের আঘাতের চে’ ক্ষিপ্র ও ভয়ানক।
১৭. একজন কবি যত বাস্তব কথা বলে গেছেন, লাবিদের কবিতার এই পঙক্তিটি তার মধ্যে অধিকতর বাস্তব; লাবিদ বলেন-
- শোনো আল্লাহ ছাড়া সকল কিছু বাতিল যে,
- হবে সকল বস্তু নিঃসন্দেহে ধ্বংস যে।
- অন্য সূত্রে জানা যায়, মহানবী সা: বলেছেন, আরবদের কাব্য-সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পঙক্তি হলো কবি লাবিদের এই চরণ।
১৮. কবি কাআব বিন জুুহায়র। অমর কবিতা ‘বানাত সুআদ’-এর রচয়িতা তিনি। এসেছেন মহানবীর সা: কাছে প্রাণভিক্ষা নিতে। সুদীর্ঘ কবিতা পড়ে চলেছেন তিনি।
- যখন বললেন-
- রাসূল আমার পূর্ণ আলোক রথ
- আঁধার রাস্তা উজ্জ্বল হয় তাতে
- খাপ হতে যেন মুক্ত চকচকে
- তীক্ষè দু’ধারী ভারতের তরবারী।
- মহানবী সা: তাকে থামালেন। বললেন, ‘ভারতের তরবারী’ নয়, বলো ‘আল্লার তরবারী’। কবি একথা শুনে তার পঙক্তি শুধরিয়ে নিলেন।
১৯. বসে আছেন প্রিয় নবী সা: কবি আন নাবিগাহ এলেন। আবৃত্তি করতে থাকলেন স্বরচিত কবিতা। যখন বললেন-
- মর্যাদা ও মহিমায় আমরা পৌঁছেছি নীলাভ্র ভেদ করে।
- আরো চাই, আরো ঊর্ধ্বে দেখা যাক আমাদের বিজয় নিশান।
- কেমন যেন বাড়াবাড়ি মনে হলো নবীর কাছে।
- প্রশ্ন করলেন আবু লায়লা (কবির ডাক নাম) তারও ঊর্ধ্বে দেখবে তোমার বিজয় নিশান, কোথায়? কবি বললেন, জান্নাতে, হে আল্লাহর হাবীব।
- এবার মহানবী সা: বললেন, ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ দেখবে একদিন।
২০. কবি সুহায়মের একটা কবিতা একবার মহানবী সা:-এর সামনে আবৃত্তি করা হলো : তার একটি চরণ ছিল এরূপ-
- স্তবকীর্তন তার করি অনিমেষ
- দয়ার দরিয়া যেন হয় না তা শেষ।
- মহানবী সা: শুনে বললেন, বেশ তো। ঠিক কথাই বলেছে কবি। এ ধরনের কথায় আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। আর যাকে আল্লাহ সোজা পথে রেখেছেন এবং নৈকটা দিয়েছেন সে জান্নাত পাবে।
২১. একবার আয়িশা সিদ্দিকা রা: জুুহায়র বিন জুনাবের একটি কবিতা আওড়াচ্ছেন। যখন পড়লেন-
- কেনই বা হেয় হবো,
- বাড়ার দু’হাত আতুরের দিকে
- একদিন পাবে নিশ্চয়ই প্রতিদান
- হাতে হাত তব দিলো সে সব কিছু।
- কিংবা
- গাইল তোমার সুকৃতি চিরদিন,
- সেটাও কিন্তু কম প্রতিদান নয়।
- রাসূল সা: শুনে বললেন, আয়েশা, কবির কথা কিন্তু ঠিক। আসলে মানুষের যে সুকৃতি গাইতে পারে না, আল্লাহরও সুকৃতি গাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।