সব মহলের দাবির পরও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের সরাসরি সুপারিশ থাকছে না বলে জানা গেছে। ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন কার্যক্রম। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং সরকারের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের তালিকায় অন্যতম হলেও এ সংস্কারটির আলোর মুখ দেখা নিয়েও শঙ্কা কাজ করছে। কারণ পরিসংখ্যান সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত সুপারিশ থাকছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আর এই সুপারিশের উপর নির্ভর করবে পরবর্তী পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ওই কমিশন গঠনের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স কমিটি আগামী সোমবার তাদের তৈরি প্রতিবেদন জমা দেবে পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো স্পষ্ট পদক্ষেপ না নেয়া এবং প্রক্রিয়াটির ধীরগতি উদ্বেগের বিষয়। পরিসংখ্যানগত তথ্যে সরকারি হস্তক্ষেপের ঝুঁকি কমাতে এবং তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন কমিশনের বিকল্প নেই।
বিবিএস ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তথ্য জালিয়াতির ব্যাপক অভিযোগ থেকে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের উদ্যোগ ভেস্তে গেলে একটি বড় সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। একটি স্বাধীন ও কার্যকর পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করা হলে দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হবে। এই ধরনের একটি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে দেশের পরিসংখ্যানবিদ ও অর্থনীতিবিদদের নিকট থেকে জানানো হচ্ছে। তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীলতা না থাকলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনাও বাস্তবায়নের মুখ দেখবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) একটি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশনে রূপান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়। অথচ সেটি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। গত ১৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সহজ ও আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে আটটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে এই বিষয়টি অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । এর পরও সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মধ্যে প্রত্যাশিত গতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়নি। এর আগে এসআইডি থেকে জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের একটি সুপারিশ রয়েছে। আমরা কাজও করছি। কিন্তু পরে পরিসংখ্যান বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠিত হওয়ায় এ কাজটি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। কারণ টাস্কফোর্সের সুপারিশ পাওয়ার পরই স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের উদ্যোগ এগিয়ে নেয়া হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জান গেছে, টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন বিষয়ে সরাসরি কোনো সুপারিশ থাকছে না। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর নাম পরিবর্তন অথবা কর্মকর্তাদের পদবি পরিবর্তনের সুপারিশ থাকতে পারে। যেমন বিবিএস’র মহাপরিচালকের (ডিজি) পদের পরিবর্তে হয়তো ‘চিফ স্ট্যাটিসটিকস অফিসার’ নাম হতে পারে। সেই সাথে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দক্ষতা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজেশন এবং সক্ষমতা বাড়ানোর মতো বিভিন্ন সুপারিশ থাকতে পারে। কেননা এই স্বল্প সময়ে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ১৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কমিশন বাস্তবায়নের নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়। সেই চিঠি পাওয়ার প্রায় এক মাস পর পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এ সংস্কারের আইনি কাঠামো তৈরির দায়িত্ব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) দিয়ে একটি চিঠি দেয়। বিবিএস গত ২০ এপ্রিল একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে। তবে ওই কমিটির কার্যপরিধি স্পষ্ট নয় এবং কোনো সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি। কমিটি গঠনের পর এখন পর্যন্ত ওয়ার্কিং কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি বলে জানা গেছে।
প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তবে সেটি জমা দেয়ার আগে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের সুপরিশ থাকছে কি না সেই প্রশ্ন করাটা ঠিক নয়। প্রতিবেদন জমার আগে এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। ওই দিনই সব জানতে পারবেন।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ শুধু কো-অর্ডিনেট করে থাকে। তবে সংস্কার বাস্তবায়নের অগ্রগতি আমরা নিয়মিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করে থাকি। স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন বিষয়ে টাস্কফোর্স কী সুপারিশ দেয় সেটি না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম তার লেখায় বলেছেন, আমাদের দেশে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করলেই দেশের সামষ্টিক তথ্য-উপাত্তগুলোর ত্রুটি দূর হয়ে যাবে আশা করা দুরাশা হবে। তবে এ দেশে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য হাসিনা সরকার যেভাবে পুরো পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক ডক্টরিং’-এর সূতিকাগারে পরিণত করেছিলেন সেখান থেকে মুক্তির পথটা খুলে যাবে নিংসন্দেহে। সে জন্যই আমি স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠনকে সময়ের অন্যতম অপরিহার্য বলে অভিহিত করেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস, রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের অধ্যাপক ড. হাসিনুর রহমান সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, বিবিএস’কে স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশনে রূপান্তরের সরকারি উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এটি আরো কার্যকর ও সময়োপযোগী করা যেত। উন্নত দেশগুলোতে পরিসংখ্যান কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে। তারা শুধু সংসদের কাছে জবাবদিহি করে। আমাদের দেশেও সেই আদলে পরিসংখ্যান চর্চা গড়ে তুলতে হবে। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহিত করে, তা হলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।