প্রাণিজখাদ্য বিশেষ করে ফিড উৎপাদনে অন্যতম প্রধান উপকরণ ভুট্টা। একটা সময় ফিড উৎপাদনের এই প্রধান উপকরণের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু বিগত এক দশকে দেশে ভুট্টাচাষে বিপ্লব ঘটেছে। দেশীয় চাহিদার বেশির ভাগই এখন যোগান দিচ্ছেন কৃষক। তুলনামূলক কম খরচে লাভ বেশি পাওয়ায় দেশের কৃষকেরা ঝুঁকছেন ভুট্টা চাষে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে দেশে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে; সেখানে বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদ বেড়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টরে ঠেকেছে। উৎপাদনও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে দেশে ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল ৮ লাখ ৮৭ হাজার টন; ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটি প্রায় ৭৩ লাখ টনে পৌঁছেছে। বিগত ১০ বছরে দেশে ভুট্টা আবাদ প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে বেশি লাভ ও সহজ চাষ পদ্ধতির কারণে কৃষকরা ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। দেশে মোট আবাদের প্রায় ৯৫ শতাংশই আবার হাইব্রিড জাতের ভুট্টা চাষ হয়। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি প্রায় ৯০ শতাংশ কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্যানুযায়ী, দেশে সিড (বীজ) ভুট্টা এবং নন সিড ভুট্টা দুটোই আমদানি হয়ে থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নন সিড তথা মানুষ ও গোখাদ্য তথা ফিড তৈরির উপাদান হিসেবে ভুট্টা আমদানি করা হয়েছে ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ টন। আর বীজ হিসেবে আমদানি করা হয়েছে ৮ হাজার ৬৬৫ টন।
দেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, রংপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, জামালপুর জেলায় ভুট্টার আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। রাজশাহী, মানিকগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার বোরো জমিতেও এখন ভুট্টার আবাদ শুরু হয়েছে। ধান, গম বা অন্য যেকোনো আবদের চেয়ে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
জানা যায়, মূলত ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে দেশে ভুট্টা আবাদের সম্প্রসারণ শুরু হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রাজস্ব খাত এবং বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ভুট্টা চাষে কৃষককে প্রণোদনা ও প্রদর্শনী দেয়া শুরু হলে বেশি লাভজনক হওয়ায় দ্রুত ভুট্টাচাষ সম্প্রসারণ ঘটে। প্রথম দিকে সরকারের মূল টার্গেট ছিল চরাঞ্চল বা অপেক্ষাকৃত কম ফলনশীল জমিতে ভুট্টা আবাদ ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু একটা সময় কৃষক ধান, গম বা অন্য আবাদ বাদ দিয়ে ভুট্টা চাষে মনোনিবেশ করেন।
কৃষক ও স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভুট্টা আবাদে পানি ও কীটনাশক অপেক্ষাকৃত কম লাগে। স্বল্প পরিচর্যায় উচ্চ ফলনের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে ভুট্টার জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। এতে পশুখাদ্য তৈরির অপরিহার্য এ উপাদানের আমদানিও কমেছে। দেশের উৎপাদিত ভুট্টার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার প্রাণিখাদ্য বা ফিডশিল্প।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত এক দশকে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। এক দশকের ব্যবধানে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩ লাখ টনে। পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ৫৬ লাখ ৬৩ হাজার টন। তবে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ঠিক কী পরিমাণ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা জানা যায়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ বছর থেকে ভুট্টাচাষে প্রণোদনা বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। মূলত ধান বা অন্য ফসলি জমি ভুট্টা দখল করায় আগামী দিনে দেশে খাদ্য সঙ্কট তৈরি হতে পারে। এ আশঙ্কায় কৃষককে ভুট্টাচাষে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের চর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক জিয়াউর রহমান জানান, গত বছর প্রায় ১৪ হাজার বিঘায় ভুট্টা চাষের প্রদর্শনী ছিল তাদের। চলতি বছর ভুট্টায় কোনো প্রদর্শনী দেয়া হয়নি। ভুট্টার পরিবর্তে তার প্রকল্প থেকে এবার প্রায় দেড় হাজার বিঘায় চীনাবাদাম চাষে প্রদর্শনী ধরা হয়েছে।
জানা যায়, শুধু চর প্রকল্প নয়, ডিএইর আরো প্রকল্প থেকে ভুট্টা চাষে প্রদর্শনী দেয়া হতো। কিন্তু এবার সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষক লাভ যেখানে বেশি পাবেন, সেটাতেই আগ্রহী হবেন- এটাই স্বাভাবিক। ভুট্টায় লাভ বেশি হওয়ায় তারা দ্রুত সেদিকেই চাষাবাদ বাড়িয়েছেন।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশে ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা ৭০-৫ লাখ টন, যার বেশির ভাগই স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। আর আমদানিও দিন দিন কমছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টনে। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছর দেশে উৎপাদন কিছুটা কম হয়। ফলে আমদানি বেড়ে ১৪ লাখ টনে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ভুট্টার বাজার তৈরি হয়েছে মূলত প্রাণিখাদ্য বা ফিডশিল্পকে কেন্দ্র করে। গত দেড় দশকে দেশে পশুপালন ও পোলট্রি শিল্প খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফিডমালিকেরা বলছেন, ক্ষুদ্র খামারিদের বাকিতে প্রাণিখাদ্য সরবরাহ করে এ খাত সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে ফিডশিল্প।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো: ওবায়দুর রহমান মণ্ডল এবং মহাপরিচালক ছাইফল আলমকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ভুট্টা উৎপাদন করে ধান কিংবা গমের চেয়ে কৃষক বেশি অর্থ পাচ্ছেন। আবার ভুট্টার একটা নিশ্চিত বাজারও রয়েছে দেশে। তা ছাড়া ভুট্টার উৎপাদনশীলতাও বেশি। কৃষকের জন্য লাভজনক হওয়ায় ধানের জমিতেও তারা ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদার পুরোটাই জোগান দিতে পারবে দেশে উৎপাদিত ভুট্টা। তখন আর আমদানির দরকার হবে না।
ভুট্টা চাষে প্রণোদন-প্রদর্শনী বাদ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পোলট্রি ফিড, ফিস ফিড বা যেকোনো ধরনের ফিড উৎপাদনের প্রধান উপকরণ এই ভুট্টা। সরকারকে আরো কয়েক বছর ভুট্টায় প্রণোদনা অব্যাহত রাখা উচিত। না হলে পোলট্রি বা গোখাদ্যের দাম বাড়বে। আমদানিনির্ভরতা বাড়বে।
তবে কৃষিবিদ আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল বলেন, ভুট্টার আবাদ বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন কৃষককে প্রণোদনা না দিলেও হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত এই পরিচালকের মতে গত কয়েক বছরে ভুট্টা চাষ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখন সরকার প্রণোদনা না দিলেও যেহেতু লাভজনক তাই কৃষক চাষাবাদ অব্যাহত রাখবে।