ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামল

নির্যাতন ও গুলিতে পঙ্গু হন সাতক্ষীরার অর্ধশত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী

সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ও ইসলামী আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে টার্গেট করা হয়েছিল জামায়াত-শিবিরকে। এ জেলায় তারা যাতে কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য ২০০৯ সালের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াত-শিবিরের ওপর দমন পীড়ন শুরু করে। যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার দিন।

মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা

Location :

Satkhira
Printed Edition

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বাকড়া গ্রামের বাসিন্দা মো: কবীর আহমেদ। গ্রামের পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে নিজে উচ্চশিক্ষিত হতে না পেরে ছেলে ওসমান গনির ভালো পড়ালেখার জন্য সাতক্ষীরা শহরের একটি নামি স্কুলে ভর্তি করান। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল স্কুলপড়–য়া ছেলেকে দেখতে শহরে আসেন কবীর। ছেলের বায়না শুনে তার জন্য মিষ্টি কিনতে যাওয়ায় ডিবি পুলিশ তাকে শহরের পোস্ট অফিস মোড়ের হালিমা হোটেল থেকে গ্রেফতার করে। কবীরের জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ততা থাকায় তাকে প্রাণে মেরে ফেলার কথা জানায় ডিবি পুুলিশ। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের শ্বশুরবাড়ি সাতক্ষীরাতে হওয়ায় সেখানে তিনি গড়ে তোলেন মৎস্য ঘের প্রজেক্ট। তার ব্যবসায়িক পার্টনার আশাশুনি উপজেলার সরাপপুর গ্রামের শামসুর রহমানের ছেলে মরহুম বসির আহমেদ। বেনজিরের আশীর্বাদপুষ্ট ভূমিদস্যু বসির আহমেদ কবীরদের প্রতিবেশী গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় তার কাছে যান ভুক্তভোগীর ভাই। এ সময় কবীরের ভাইয়ের কাছে দুই লক্ষ টাকা দাবি করে তার ভাইকে মেরে না ফেলার জন্য। সন্ধ্যায় দেড় লক্ষ টাকায় সমঝোতা হয়। পরে কবীর আহমেদকে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে আশাশুনি থানার উদেশ্যে যাওয়ার সময় গভীর রাতে আশাশুনি সড়কের মহেশ্বরকাটি এলাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে পুলিশ তার পায়ে গুলি করে। উন্নত চিকিৎসার পরও তার পা ভালো না হওয়ায় পঙ্গুত্ববরণ করে কবীর বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পঙ্গু হওয়ার পরেও তার নামে পুলিশ পাঁচটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ অবস্থায়ও বিচারিক আদালতে হাজির হতে হয়। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরাতে। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের জন্য চরম আতঙ্কের জেলা ছিল সাতক্ষীরা। নির্যাতন ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ৩৭ জন নেতাকর্মীকে। এ সময় ফ্যাসিস্টদের দোসর ও তাদের পেটুয়া বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ও গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন অর্ধশতাধিক জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী।

সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ও ইসলামী আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে টার্গেট করা হয়েছিল জামায়াত-শিবিরকে। এ জেলায় তারা যাতে কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য ২০০৯ সালের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াত-শিবিরের ওপর দমন পীড়ন শুরু করে। যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার দিন। এ দিন বিকেলে শহরের অদূরে সার্কিট হাউজ মোড়ে জামায়াতের শান্তিপূর্ণ মিছিলে যৌথবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সাত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে। এ ঘটনায় আহত হয় আরো অনেকে।

এ ঘটনার পর থেকে সাতক্ষীরা শহরসহ পুরো জেলা পরিণত হয় আতঙ্কের এলাকায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু হয় হয়রানি ও নির্যাতন। সরকারদলীয় লোকজন পুলিশকে ব্যবহার করে জামায়াত-শিবির দমনে মেতে ওঠে। প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হতো।

একইসাথে চলে গ্রেফতারের নামে অর্থ বাণিজ্য। টাকা নেয়ার পরও আটক জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের কারো পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হতো। আবার অনেককে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে গুরুতর আহত করা হতো। এ সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হওয়ার পাশাপাশি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন অনেকে। পায়ে গুলিবিদ্ধ অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পায়ে গুলিবিদ্ধ বাকিদের পক্ষে এখনো স্বাভাবিক চলাচল সম্ভব হচ্ছে না।

এভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের নামে নির্যাতনের শিকার ৩৪ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে।

আহত জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন, সাতক্ষীরা সদরের রইচপুর গ্রামের আমিরুল ইসলাম লাভলু (পা কাটা), দেবহাটার গরানবড়িয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ (গুলিবিদ্ধ), একই উপজেলার মাসুম বিল্লাহ (গুলিবিদ্ধ), আকবার আলী (গুলিবিদ্ধ), সাদ্দাম হোসেন (গুলিবিদ্ধ), আব্দুস সবুর (গুলিবিদ্ধ), আবুল হোসেন (গুলিবিদ্ধ), বদরুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), মেহেদী হাসান (গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রশিদ মোল্লা (গুলিবিদ্ধ), ভ্যাদল (গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রউফ (গুলিবিদ্ধ), রিয়াজুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), আয়নুল হক (গুলিবিদ্ধ), কালিগঞ্জের চৌমুহনীর আশরাফুল ইসলাম বাবু (গুলিবিদ্ধ), রবিউল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), শুশিলগাতির ফারুক হোসেন (গুলিবিদ্ধ), দেবহাটার কুলিয়ার মাসুম বিল্লাহ (২২) (ধরে পাছায় গুলি করে পুলিশ), ভাড়ামিশলার আরিফুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), দাদপুরের ইব্রাহিম (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের মিয়ারাজ (গুলিবিদ্ধ), চালতেবাড়িয়ার রবিউল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের রিয়াজুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), আব্দুর রউফ (গুলিবিদ্ধ), সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রইচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সোহাগ (১২) (গুলিবিদ্ধ), রইচপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইছাহাক (৩২) (গুলিবিদ্ধ), একই গ্রামের হোসেন ওরফে বাচা (২২) (গুলিবিদ্ধ)।

এ ছাড়া সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকার একটি মেচে ঢুকে পুলিশ সাত শিবির কর্মীকে আটক করে তাদের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরা হলো আবু তালেব (গুলিবিদ্ধ), আব্দুল গফুর (গুলিবিদ্ধ), আব্দুস সবুর (গুলিবিদ্ধ), ইমরান হোসেন (গুলিবিদ্ধ), আজিজুল ইসলাম (গুলিবিদ্ধ), আক্তার হোসেন (গুলিবিদ্ধ), নুর মোহাম্মাদ (গুলিবিদ্ধ)।

এ ছাড়া আ’লীগের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন কলারোয়া উপজেলার বৈদ্যপুর গ্রামের মিলন হোসেন, আবু ওবায়দা, শাহানারা খাতুন, ক্ষেত্রপাড়া গ্রামের মুকুল হোসেন, হুমায়ূন কবির, মাদরা গ্রামের মফিজুল ইসলাম, কলারোয়া গ্রামের শামসুল আলম বুলবুল, জয়নগর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, সদর উপজেলার রহচপুর গ্রামের আমিরুল ইমলাম লাভলু, কাশেমপুর গ্রামের আব্দুল আহাদ, চপড়িয়া গ্রামের আব্দুর রহমান, আশাশুনির সরাপপুর গ্রামের কবির আহমেদ, নৈকাটি গ্রামের আল আমিন, দেবহাটার গরানবাড়িয়া গ্রামের রুহুল আমিন, মাঝসখিপুর গ্রামের রশিদ মোল্যা, সখিপুর গ্রামের মিলন হোসেন, পারুগ্রামের ফারুক হোসেন, একই গ্রামের আবু হোরায়রা, জগন্নাথপুর গ্রামের আহাদ উল্লাহ, শ্যামনগরের কাশিমাড়ি গ্রামের নজরুল ইসলাম, কালিগঞ্জের মাটিকুমড়া গ্রামের ফিরোজ হোসেন, দেবহাটা ভাড়াশিমলা গ্রামের রবিউল ইসলাম, সদর উপজেলার ইটাগাছা গ্রামের মফিজুল ইসলাম প্রমুখ।

এ ব্যাপারে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আজিজুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ পুলিশকে ব্যবহার করে বিরোধী পক্ষকে দমনপীড়ন করেছে যেটি কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র হতে পারে না। তিনি দাবি করেন তাদের ৩৭ জন নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে। অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করে এখনো অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

আইনজীবী আবু তালেব বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরাতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা ও রাজনৈতিক মামলা হয়েছে ৯৪৯টি। ইতোমধ্যে সাত শতাধিক মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রঞ্জাপনের মাধ্যেমে নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রক্রিয়াধীন। আমরা সব রাজনৈতিক, হয়রানি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেকের সাজা হয়েছে, উচ্চ আদালত হতে জামিনে মুক্ত হয়েছে।