পর্যটনের ছোঁয়ায় বদলে গেছে শ্রীমঙ্গলের রাধানগর

পর্যটনের কল্যাণে রাধানগরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫০০ মানুষের। কেউ রিসোর্ট পরিচালনা করছেন, কেউ রেস্তোরাঁ বা পর্যটক পরিবহনে নিয়োজিত। অনেকে হস্তশিল্প, চা পাতা, মনিপুরী কাপড়, সুভেনির বিক্রি বা গাইডের কাজ করছেন। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তারাও ছোটখাটো দোকান ও ক্যাফে পরিচালনায় যুক্ত হয়েছেন।

এম এ রকিব, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)
Printed Edition
রাধানগর গ্রামে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বাঁশের তৈরি ঘর
রাধানগর গ্রামে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বাঁশের তৈরি ঘর |নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর্যটনের প্রবেশদ্বার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। চায়ের রাজধানীখ্যাত এই শহর এখন শুধু চা বাগানের জন্যই নয়, পর্যটনের জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছে। তারই অনন্য উদাহরণ সদর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রাম; যা আজ পরিচিত ‘পর্যটনের গ্রাম’ নামে। একসময় কৃষিনির্ভর ও নিস্তব্ধ এই গ্রাম এখন শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের জায়গা, বিনিয়োগকারীদের নতুন গন্তব্য এবং দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাধানগর একসময় আখ, লেবু ও কাঁঠাল চাষে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর শ্রীমঙ্গলে পর্যটনের বিকাশ ঘটতে থাকে গ্রামটিতে। ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়া বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করার পর বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সেই সময় ‘নিসর্গ ইকো কটেজ’ নামে প্রথম পর্যটক কটেজ গড়ে ওঠে। এরপর গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের মতো পাঁচ তারকা রিসোর্টের সাফল্য দেখে অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন।

রাধানগরের রিসোর্টগুলোর স্থাপত্য ও নকশা বেশ ব্যতিক্রমী। বাঁশ, কাঠ ও প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধবভাবে এগুলো নির্মিত। এখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- হোটেল প্যারাগন, নভেম ইকো রিসোর্ট, বালিশিরা রিসোর্ট, শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্ট, লিচিবাড়ি ইকো রিসোর্ট, অরণ্যের দিনরাত্রি, নিসর্গ নিরব ইকো কটেজ, জলধারা ও বৃষ্টিবিলাস রিসোর্টসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান।

পর্যটনের কল্যাণে রাধানগরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৫০০ মানুষের। কেউ রিসোর্ট পরিচালনা করছেন, কেউ রেস্তোরাঁ বা পর্যটক পরিবহনে নিয়োজিত। অনেকে হস্তশিল্প, চা পাতা, মনিপুরী কাপড়, সুভেনির বিক্রি বা গাইডের কাজ করছেন। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তারাও ছোটখাটো দোকান ও ক্যাফে পরিচালনায় যুক্ত হয়েছেন।

চামুং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ইকো ক্যাফের পরিচালক তাপস দাশ বলেন, প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রামটি পর্যটকে মুখর থাকে। এতে স্থানীয়দের আয় যেমন বাড়ছে, তেমনি সরকারও পাচ্ছে রাজস্ব।

শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্টের পরিচালক তানভীর লিংকন আহমেদ বলেন, ২০১২ সালে আমরা পরিবেশবান্ধব ইকো রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করি। এখন এখানে অসংখ্য নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

পর্যটনের বিকাশের সাথে সাথে গ্রামটিতে বদলে গেছে জীবনযাত্রা। আগে যেখানে কৃষিকাজই ছিল প্রধান পেশা, এখন অনেকে সেবা খাতের সাথে যুক্ত। বাড়ির উঠোনে ছোট গেস্ট হাউজ তৈরি করে নারী-পুরুষ মিলেই গড়ে তুলছেন নতুন জীবিকা।

রাধানগর পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্যসচিব তারেকুর রহমান পাপ্পু বলেন, রাধানগরে এখন কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে। এতে স্থানীয়দের আত্মনির্ভরতা বাড়ছে, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। সরকারি অবকাঠামো উন্নয়ন হলে বিনিয়োগ আরো বাড়বে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ইসলাম উদ্দিন জানান, পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমরা ইতোমধ্যে রাধানগরে রাত্রীকালীন সড়কবাতি স্থাপন করেছি। আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বিকাশে কাজ এগিয়ে চলছে।

রাধানগর এখন নিছক একটি গ্রাম নয়; এটি বাংলাদেশের পর্যটনের এক সফল মডেল। যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য, উদ্যোক্তাদের শ্রম ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ মিলেই গড়ে উঠেছে একটি জীবন্ত পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতি। চায়ের সুবাসে ভরা এ অঞ্চলের সবুজ পাহাড় ও টিলা পেরিয়ে যখন কেউ রাধানগরে প্রবেশ করেন, তখনই বোঝা যায়; পর্যটনের স্পর্শ কিভাবে বদলে দিতে পারে একটি পুরো গ্রামকে।