বাংলাদেশের কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে কীটনাশক অপরিহার্য উপাদান। দেশের কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এই বাজারে দেশীয় উৎপাদকরা নানা শুল্ক বাধার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। অন্য দিকে, তুলনামূলক সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা দিন দিন আরো লাভবান হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে একাধিক প্রতিষ্ঠান কীটনাশক উৎপাদন বা ফরমুলেশন কারখানা স্থাপন করেছে। কিন্তু কাঁচামাল আমদানির েেত্র উচ্চ শুল্ক ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে তাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় স্থানীয় পণ্য বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। তারা বলছেন, দেশীয় উদ্যোক্তারা কাঁচামালে ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিয়ে থাকে। অথচ আমদানিকৃত তৈরি পণ্য মাত্র ১০-১৫ শতাংশ শুল্কে আসে, তা হলে দেশীয় উৎপাদক কিভাবে টিকবে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিল্প উন্নয়নের সুযোগই থাকবে না বলে উদ্যোক্তারা জানান।
বর্তমানে বাজারে যে পরিমাণ কীটনাশক সরবরাহ হয়, তার বড় অংশই সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করা। কম শুল্ক, দ্রুত ছাড়পত্র প্রক্রিয়া এবং অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়ায় আমদানিকারকরা দাম নিয়ন্ত্রণে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ, স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে বাজারে টিকে থাকতে হলে প্রায় সমান দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়, যদিও তাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। কৃষক পর্যায়ে এর প্রভাবও কম নয়। শুল্ক বৈষম্যের কারণে স্থানীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতা করতে না পারায় বাজার পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে উঠছে। এতে আমদানিকারকদের হাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে কৃষকদের জন্য বাড়তি দামের ঝুঁকি তৈরি করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিপ্রধান দেশে স্থানীয় কীটনাশক শিল্প গড়ে উঠলে তা কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি উন্নয়নে সহায়তা করত। কিন্তু শুল্ক নীতির অসামঞ্জস্যতার কারণে দেশীয় উৎপাদন নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এক অধ্যাপক মন্তব্য করে বলেন ‘আমাদের নীতি প্রণয়নে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব রয়েছে। এক দিকে আমরা স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করার কথা বলি, অন্য দিকে শুল্ক কাঠামোতে আমদানিকারকদের সুবিধা দিয়ে দিই। এতে দীর্ঘমেয়াদে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকার স্থানীয় শিল্প সুরায় সচেষ্ট। তবে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্য নীতির কারণে কিছু েেত্র সরাসরি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার। যাতে আমদানিকারক ও স্থানীয় উৎপাদক উভয় পরে জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়।’
তথ্যে দেখা যায়, গত বাজেট বক্তব্যে কৃষি খাতে ব্যবহৃত কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহারসহ উৎপাদনবান্ধব শিল্পনীতিতে গুরুত্ব দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু শুল্কনীতির কারণে দেশের শিল্পকারখানায় কৃষি ফসলের সুরার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান কীটনাশক উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ কীটনাশক উৎপাদনে ব্যহৃত কাঁচামাল আমদানিতে সর্বোচ্চ ৮০% পর্যন্ত সরকারকে শুল্ক দিতে হয় উদ্যোক্তাদের। আর কীটনাশক আমদানিতে মাত্র ৫% শুল্ক পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারকদের।
এমন পরিস্থিতিতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রফতানিমুখী স্থানীয় শিল্পের বিকাশে বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত সুবিধা চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বালাইনাশক উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ এগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএএমএ)।
বিএএমএ জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য অনুযায়ী বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এক লাখ টন বালাইনাশকের বাজার রয়েছে, যার প্রায় ৯৫ শতাংশ আমদানি নির্ভর। আমদানিকারকরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ফিনিশড পণ্য আমদানি করছেন, সিন্ডিকেট চক্র না থাকলে ও অতি মুনাফা বন্ধ হলে সমপরিমাণ কীটনাশক আমদানি সম্ভব ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকায়। সেই সাথে কাঁচামাল ও সহযোগী পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক তুলে নিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করলে একই পরিমাণ বালাইনাশক কৃষকের হাতে পৌঁছাতে ব্যয় হবে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে এক হাজার ৩৮০ জন আমদানিকারক রয়েছেন বালাইনাশকের জন্য। তবে এনবিআর জানিয়েছে সর্বশেষ গত অর্থবছরে মাত্র ২১১ জন আমদানিকারক পণ্য আমদানি করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানিতে সক্রিয় না থাকলেও শত শত আমদানিকারক বিভিন্নভাবে বালাইনাশক নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বাজারজাত করছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। মূলত বহুজাতিক ও স্থানীয় কয়েকটি কোম্পানির আমদানি ফিনিশড পণ্যে আমদানি মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট চক্র।
বিএএমএ’র সভাপতি কৃষিবিদ কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল বা সহযোগী উপাদানগুলোর এইচ এস কোডকে কাস্টমস প্রসিডিউর কোডের অন্তর্ভুক্ত করে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা দিলে এ খাতের বিকাশ ঘটবে। এতে আমদানি কমে আসবে। তিনি বলেন, বালাইনাশকের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা। হাতেগোনা কয়েকজন কীটনাশক আমদানি করে। বাকিরা ভাগবাটোয়ারা করে চলে। এরাই দেশে ভেজাল কীটনাশক বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ করেন।
উল্লেখ্য, চীন ও ভারতে আমদানিকৃত পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির েেত্র শুল্কহারের পার্থক্য যথাক্রমে প্রায় ৪০% ও ৩০% এর অধিক রাখা । ফলে ওই দেশে বালাইনাশক প্রায় ১০০% উৎপাদন হয়ে থাকে এবং পৃথিবীর প্রায় ৬৫% বালাইনাশক ওই দুই দেশ থেকে রফতানি হয়ে থাকে। কীটনাশক আমদানি নিরুৎসাহিত করতে দেশী কোম্পানির উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির শুল্কহার শূন্য করার আহ্বান জানান প্রস্তুতকারকরা।