আরিফিন রিয়াদ গৌরনদী (বরিশাল)
এক সময় স্রোতস্বিনী, প্রাণবন্ত ও জীবনধারার অবলম্বন ছিল বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত টরকী-বাশাইল খাল। নৌকা চলত, মানুষ সেচ পেত, ছিল দেশীয় মাছের অফুরন্ত সম্ভার। কিন্তু আজ খালটি প্রায় মৃত। খননের অভাব, দখল, দূষণ ও নদীর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে খালটি হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব।
সরেজমিন দেখা গেছে, খালের দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও অবৈধ স্থাপনা। কোথাও জমে থাকা পলি ভরাট করেছে খালের বুক, কোথাও জন্ম নিয়েছে ধানগাছ ও আগাছা। আর কোথাও খালের অস্তিত্বই মুছে গেছে মানচিত্র থেকে। স্থানীয় কৃষকরা জানালেন, খালে পানি না থাকায় ধান চাষ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে জমি ফেটে যাচ্ছে, আবার সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি।
কাইমেট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের আগৈলঝাড়া শাখার পরিবেশ কর্মী সৈয়দ মাজারুল ইসলাম রুবেল বলেন, ‘বছরের পর বছর খালটি খনন না করায় নাব্যতা সঙ্কট চরমে। পালরদী নদীর মোহনা উঁচু হয়ে যাওয়ায় পানি আর খালে প্রবেশ করতে পারে না। খালের মুখে বাঁধ ও অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণের কারণে পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এতে কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য তিনই হুমকির মুখে।
স্থানীয়রা জানান, টরকী-বাশাইল খাল এক সময় এ অঞ্চলের প্রধান নৌপথ ছিল। এখন শীত মৌসুমে খালটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। বোরো মৌসুমে চাষিরা সেচ পেতে কৃত্রিম পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করছেন, এতে খরচ বাড়ছে কয়েকগুণ। ২০ হাজার হেক্টর জমির কৃষি নির্ভরশীল এই খাল এখন কৃষকদের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় কৃষক রাজিব সরদার জানান, ‘প্রতি ২০ শতক জমি চাষে সেচ বাবদ তিন শতক জমির ধান ব্লক ম্যানেজারকে দিতে হয়। এতে কৃষকরা তিগ্রস্ত হচ্ছেন, অনেকেই ধানচাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ পানের বরজ করছেন, কেউ মাছের ঘের দিচ্ছেন।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানালেন, এক সময় এই খালে শতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছ মিলত। এখন পানির অভাবে মাছ বিলুপ্তপ্রায়, মশা ও পানিবাহিত রোগের উৎপাত বেড়েছে।
সাবেক ইউপি সদস্য ছাদের আলী সরদার বলেন, ‘আমাদের শৈশবে খালটিতে এত স্রোত ছিল যে সাঁতরে পার হতাম। এখন খালটা মৃত। মাছ নেই, ফসল নেই, কৃষকের মুখে শুধু হতাশা।’
স্থানীয়রা একাধিকবার জনপ্রতিনিধি ও কৃষি বিভাগে আবেদন করেও কোনো ফল পাননি।
বরিশাল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘খাল ও নদী খননের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের পানি সংরণ করা গেলে সেচের খরচ কমবে, কৃষি উৎপাদন বাড়বে। খাল খননে অচিরেই উদ্যোগ নেয়া হবে।’
এক সময়ের জনজীবনের প্রাণ টরকী-বাশাইল খাল আজ নিঃশেষ হওয়ার পথে। যদি এখনই উদ্যোগ না নেয়া হয়, তবে হারিয়ে যাবে বরিশালের কৃষি ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।