স্বীকৃতি দেয়ার তাৎপর্য
- কূটনৈতিক বৈধতা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা
- আইনগত ও চুক্তিভিত্তিক অধিকার
- সহযোগিতা ও সহায়তার সুযোগ
- রাজনৈতিক ও ন্যারেটিভ পরিবর্তন
অবশেষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ঐতিহাসিক মোড় নিলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি ইস্যুতে। ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া একযোগে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক জটিলতা ও মানবিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিউ আরব, টাইমস অব ইসরাইল, এবিসি ও বিবিসি।
গতকাল রোববার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের প্রাক্কালে এই তিন দেশের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় যে, তারা ফিলিস্তিনের জনগণের ‘স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন’কে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ নিউ ইয়র্কে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আজকের স্বীকৃতি অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘদিনের দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে, যা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার একমাত্র পথ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি তার ঘোষণায় বলেন, বর্তমান ইসরাইলি সরকার পরিকল্পিতভাবে এমনভাবে কাজ করছে, যাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা কখনো বাস্তবায়িত না হয়। তিনি আরো বলেন, কানাডা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গঠনে উভয় রাষ্ট্রের সাথে অংশীদারিত্বে কাজ করতে প্রস্তুত। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারও একই দিনে ঘোষণা দেন যে, ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন ব্রিটেনে রাষ্ট্রীয় সফরে ছিলেন, তবুও ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে ট্রাম্পের সফর শেষ হওয়ার পরপরই তারা এই ঘোষণা দেবে।
এই স্বীকৃতিগুলো এসেছে এমন এক সময়ে, যখন গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘের তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, গাজায় ‘গণহত্যা’ চলছে বলে ‘যথেষ্ট প্রমাণ’ রয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এটি আমাদের জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্মান।
তবে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে ‘সন্ত্রাসের পুরস্কার’ বলে অভিহিত করেছেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তারা পশ্চিমতীরের কিছু অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নিতে পারেন। বিশ্বজুড়ে ১৪৭টি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইংল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার এই সিদ্ধান্ত সেই তালিকায় নতুন মাত্রা যোগ করল, বিশেষ করে তারা জি৭-এর সদস্য হওয়ায় এই স্বীকৃতি আরো কূটনৈতিক গুরুত্ব বহন করছে। এই স্বীকৃতি শুধু প্রতীকী নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থান যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। তবে বাস্তবায়নের পথে রাজনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া যদি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়- তা কেবল সিম্বলিক নয়, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আইনগত দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। নিচে রয়েছে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ-
স্বীকৃতি দেয়ার তাৎপর্য : ফিলিস্তিন আত্মনিয়ন্ত্রণকারী একটি রাষ্ট্র হিসেবে আরো বেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। যারা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের ওপর চাপ বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (যেমন জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য) ফিলিস্তিনের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা নিতে উৎসাহিত হতে পারে।
রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি মানে হয়তো কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কাঠামোতে অংশগ্রহণের অধিকার, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়বে। এটি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে তার নিয়ন্ত্রণযোগ্য এলাকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে আরো খোলামেলা দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো মোকাবেলা করার জন্য শক্তি দেবে।
আন্তর্জাতিক অর্থ ও উন্নয়নমূলক সহায়তা, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় প্রকল্পগুলোর জন্য বেশি স্বীকৃতি পাওয়া যেতে পারে। ফিলিস্তিনি প্রশাসন যদি নির্দিষ্ট রিফর্ম ও ভালো গভর্নেন্স নিয়ে কাজ করে, তাহলে বৈধ পার্টনার হিসেবে সহযোগিতা বাড়বে- যেমন কানাডিয়ান ঘোষণায় বলা হয়েছে, নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ও প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদিতে কাজ করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা বাড়বে।
এই ধরনের স্বীকৃতি একটি রাজনৈতিক সঙ্কেত- বিশ্বের অনেক দেশের কাছে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্ব স্বীকৃতি পাওয়া উচিত বলে একটি নতুন আলোচনা শুরু করা হবে। এটি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের নিরপেক্ষ বা দ্বিতীয়-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষগুলোর অবস্থান শক্ত করতে পারে। জনগণের মনমত, মিডিয়া ও সরকারি নীতিনির্ধারণে এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্য থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া আশা করা যায়- ইসরাইল ও তার মিত্ররা এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করতে পারে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার, রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। এ ছাড়া স্বীকৃতি নিলেই সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলে যাবে না- বাস্তবে জমি নিয়ন্ত্রণ, সীমা নির্ধারণ, নিরাপত্তা ইত্যাদিতে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে যাবে।
স্বীকৃতি দেয়া হলেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে
১. প্রায়ই প্রতিটি দেশের আইন ও নীতি অনুসরণে কাজ করবে- অর্থাৎ, স্বীকৃতি মিললেই সব অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক বা কূটনৈতিক কাজ সহজে শুরু হবে না যদি ফিলিস্তিনের প্রশাসন বা নেতৃত্বর কাঠামোগত পরিবর্তন ও শর্তগুলো পূরণ না হয়। যেমন- কানাডা বলেছে নির্বাচন হবে, প্রশাসন সংস্কার হবে, হামাস কোনো ভূমিকা রাখবে না ইত্যাদি শর্ত থাকবে।
২. বসতি সম্প্রসারণ ও বাস্তব নিয়ন্ত্রণ- অনেক এলাকায় ইসরাইল এখনো বসতি সম্প্রসারণ এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে। শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হওয়া মানে সেসব নিয়ন্ত্রণ হঠতে শুরু করবে এমন নয়।
৩. সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ শাসন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ফিলিস্তিন কি পারবে পুরো অঞ্চলের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন (যেমন হামাস ও ফাতাহর মধ্যে) সামলাতে- এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ।
৪. আর্থিক ও মানবিক অবস্থা- স্বীকৃতি থাকলেও গাজাসহ ফিলিস্তিন অঞ্চলে মানুষের জীবনযাপন পরিস্থিতি, উদ্ধারপথ, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব ইত্যাদির সমস্যা দ্রুত দূর হবে এমন আশা করা ঠিক হবে না। ধারাবাহিক কার্যকর নীতি ও তহবিল দরকার হবে।
সারকথা হলো- স্বীকৃতি দেয়া একটি বড় কূটনৈতিক ও নৈতিক পদক্ষেপ, যা ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্বের স্বপ্নকে আন্তর্জাতিকভাবে আরো শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সাহায্য করতে পারে। এটি ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’কে পুনরায় গুরুত্ব এবং ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে নতুন উদ্দীপনা দিতে পারে। তবে এটি সম্পূর্ণ নয়- বাস্তব পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, নিরাপত্তাগত ও অর্থনৈতিক বহু কাজ এখনো বাকি।
ইসরাইল ক্ষমা না চাইলে মধ্যস্থতায় ফিরবে না কাতার
গাজায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতায় ফেরার আগে দোহায় হামলার জন্য ইসরাইলকে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায়, কাতার আর মধ্যস্থতায় ফিরবে না। এমনটাই ইসরাইলকে জানিয়েছে দোহা। এ বিষয়ে অবগত দু’টি সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক্সিওস।
কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরাইলের ওই হামলার পর মধ্যস্থতা থেকে সরে দাঁড়ায় কাতার। ট্রাম্প প্রশাসনের বিশ্বাস, কাতারের মধ্যস্থতা ছাড়া ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি এবং যুদ্ধ শেষ করার চুক্তি করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কাতারকে ‘সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা’ বলে অভিযোগ করেছেন এবং হুমকি দিয়েছেন ভবিষ্যতে ইসরাইল আবারো হামলা চালাতে পারে।
এখন ক্ষমা চাওয়া নেতানিয়াহু এবং তার কট্টর ডানপন্থী জোটের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরক সিদ্ধান্ত হবে। তবে এ বিষয়ে অবগত একটি সূত্র বলছে, ইসরাইলের রাজনৈতিক জটিলতা কাতার বোঝে এবং তারা ক্ষমা চাওয়ার ভাষা নিয়ে নমনীয় হতে রাজি। ১০ দিন আগে দোহায় ইসরাইলের ওই হামলায় হামাসের পাঁচ সদস্য এবং কাতারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন। তবে হামাসের সব শীর্ষ নেতা বেঁচে যান। প্রথমবারের মতো কোনো উপসাগরীয় দেশে ইসরাইল এ ধরনের বিমান হামলা চালাল। এতে ইসরাইলের আঞ্চলিক একঘরে হওয়ার সঙ্কট আরো গভীর হয়। এক জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেছেন, কাতারে হামলা চালিয়ে যে ধরনের বড় সঙ্কট তৈরি হবে তা ইসরাইল অবমূল্যায়ন করেছিল। তিনি আরো বলেন, নেতানিয়াহু বুঝতে পেরেছেন তিনি ভুল হিসাব করেছিলেন। গাজা নিয়ে আলোচনা ফের শুরু করতে ইসরাইল-কাতারের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। দু’টি সূত্র জানিয়েছে, কাতারের এই অনুরোধ এসেছে আমির শেখ তামিম বিন হাম্মাদ আলে সানির কাছ থেকে। গত মঙ্গলবার দোহায় বৈঠকের সময় তিনি এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সাথে কথা বলেছেন।
জানা গেছে, রুবিওর সাথে নেতানিয়াহু এবং মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ও ইসরাইলের কৌশলবিষয়ক মন্ত্রী রন ডারমারের বৈঠকেও কাতারের অনুরোধের প্রসঙ্গ উঠেছে। উইটকফ আগামী শনিবার নিউইয়র্কে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আলে-সানির সাথে বৈঠক করবেন। লক্ষ্য হলো ইসরাইল-কাতার সঙ্কটের অবসান ঘটানো এবং আলোচনা আবার শুরু করা। এ বিষয়ে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, কাতার ইসরাইলের কাছ থেকে এমন এক ধরনের ক্ষমাপ্রার্থনা মেনে নিতে পারে, যেখানে কেবল নিহত কাতারের নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে দুঃখ প্রকাশ থাকবে এবং তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে কাতারের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন না করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। এর আগেও এমন ক্ষমা চেয়েছে। ২০১৩ সালে নেতানিয়াহু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের কাছে ২০১০ সালের গাজা ফ্লোটিলা অভিযানে তুর্কি কর্মীদের হত্যার ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।
আল-শিফা হাসপাতাল ছাড়বেন না চিকিৎসকরা : ইসরাইলের স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ধারাবাহিক হামলায় গাজা শহরের কাঠামোগত ধ্বংসলীলা চললেও, শহরের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন না। এক সময় গাজার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ছিল আল-শিফা হাসপাতাল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর একাধিকবার ইসরাইলি স্থল ও বিমান হামলায় হাসপাতালটি এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। তবুও, ফিলিস্তিনিরা এটিকে শক্তি ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে দেখেন।
হাসপাতালের একটি পুরনো ক্লিনিক ভবনের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা এখন জরুরি বিভাগে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে ইসরাইলি হামলায় আহত বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত সার্জারি বিভাগটির একটি অংশ এখন শয্যাশায়ী রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় বহু বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষ ও ইসরাইলি হামলার মধ্যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। একজন অস্ট্রেলীয় স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক, যিনি বর্তমানে গাজা শহরের এই সঙ্কটাপন্ন হাসপাতালে কাজ করছেন, জানিয়েছেন যে চিকিৎসকরা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাজ করছেন।
‘এই চিকিৎসকদের মধ্যে যে দৃঢ়তা দেখেছি, তারা সত্যিই বীর,’ তিনি আলজাজিরাকে বলেন। তিনি জানান, চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা হাসপাতালেই বসবাস ও কাজ করছেন। ‘আমরা মাত্র দুই সপ্তাহ ধরে এখানে আছি; কিন্তু যে পরিমাণ ট্রমা ও কঠোর পরিশ্রম দেখছি, তা বোঝা অসম্ভব। কোনো মানুষ এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে, তা ভাবাই কঠিন।’ হাসপাতালের পরিচালক ডা: মুহাম্মদ আবু সালমিয়া ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি সাত মাসেরও বেশি সময় ইসরাইলি বন্দিত্বে ছিলেন। অভিযোগ ছিল, হামাস আল-শিফা হাসপাতালকে ‘সন্ত্রাসবাদের’ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে যা প্রমাণিত হয়নি। বন্দিত্বকালীন সময়ে তিনি নির্যাতন ও অপমানের শিকার হন। পরে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি পান।
গত শনিবার, ইসরাইলি বিমান হামলায় তার পারিবারিক বাড়িতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন- তার ভাই, ভাবী এবং তাদের সন্তানরা। তিনি নিজেই তাদের লাশ আল-শিফা হাসপাতালে দেখেছেন। ‘আমাদের চিকিৎসা দল এই হাসপাতাল কমপ্লেক্সে চরম চাপের মধ্যেও মানবিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে,’ আবু সালমিয়া আলজাজিরার ইব্রাহিম আল-খালিলিকে গাজা শহর থেকে বলেন। ‘তাদের বার্তা স্পষ্ট : আমরা রোগী ও আহতদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
আল-শিফা হাসপাতাল গাজার বহু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের একটি, যা ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল গাজা উপত্যকার অধিকাংশ অবকাঠামোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে অবস্থিত নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের পরিচালক ডা: আহমদ আল-ফাররা বলেন, তিনি গাজাজুড়ে চিকিৎসা দলগুলোর জন্য গভীর সহানুভূতি অনুভব করেন, যারা একই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। ‘এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইল চিকিৎসা দলগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বন্দী করছে, এমনকি তাদের পরিবারকেও লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে,’ তিনি আলজাজিরাকে বলেন। তিনি জানান, রেকর্ডসংখ্যক চিকিৎসক ও জরুরি সেবাকর্মী নিহত হয়েছেন। ‘আপনি যদি গাজায় থাকেন, তাহলে আপনাকে প্রতিটি সম্ভাব্য উপায়ে হত্যা করা হচ্ছে।’
গাজা থেকে রকেট হামলার অভিযোগ : গাজা থেকে ইসরাইলের উপকূলীয় শহর আশদোদ লক্ষ্য করে দু’টি রকেট ছোড়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। আশদোদে হামলার পর নিকটবর্তী শহরগুলোতে সাইরেন বেজে ওঠার কারণে হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আহত বা বড় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
গতকাল রোববার সকালে ছোড়া এসব রকেটের একটি ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিহত করা গেলেও অপরটি খোলা জায়গায় আঘাত হেনেছে বলে আইডিএফের বরাতে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরাইল। খবরে বলা হয়, ব্যাপক অভিযানের কারণে গাজা থেকে প্রজেক্টাইলসহ দূরপাল্লার আক্রমণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে আইডিএফের স্থল আক্রমণের কারণে গাজার প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
গতকাল ইসরাইলি হামলায় ৫৩ জন নিহত : গতকাল ভোর থেকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশির ভাগই গাজা শহরের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, তিন বছর বয়সী শিশু হাবিবা আবু শার ‘অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে’ মৃত্যুবরণ করেছে।
গাজা শহর থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, আশ্রয়স্থল থেকে পালানোর পর ইসরাইলি কোয়াডকপ্টার তাদের ধাওয়া করে। গাজা শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়া উদ্ধারকর্মীদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি ড্রোন গুলি চালায়। গাজা শহরের একটি আবাসিক এলাকায় ইসরাইলি রাতের হামলায় বহু সদস্য হারানো একটি ফিলিস্তিনি পরিবার ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া স্বজনদের উদ্ধারে বিশ্ববাসীর কাছে জরুরি সহায়তার আবেদন জানিয়েছে। মধ্যগাজার বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত সাতজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে চারজন শিশু রয়েছে।
সাবরা এলাকার একটি আবাসিক ভবনে ইসরাইলি হামলায় ডোগমুশ পরিবারের অন্তত ২৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। হামলার পর ১৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো প্রায় ৫০ জন আটকে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একজন স্বজন বলেন, ‘আমাদের পরিবার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে। আমরা তাদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি; কিন্তু পৌঁছাতে পারছি না। তিনি আরো জানান, উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি ড্রোন গুলি চালাচ্ছে। প্রতিবার পাঁচজন এগিয়ে গেলে, চারজন নিহত হন, একজনই বেঁচে ফেরেন।’ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলের আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৫ হাজার, ২৮৩ নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৫ জন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরো হাজার হাজার মানুষ চাপা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।