বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ভুবনে এক বহুমাত্রিক সৃজনশীল ব্যক্তির নাম হাসান হাফিজ। নিজেকে তিনি উপস্থাপন করেছেন নানা আঙিকে, নানা পরিসরে। কবিতা, ছড়া, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, রূপকথা, প্রবন্ধ, সম্পাদনা কিংবা সাক্ষাৎকার- সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার বিচরণ বিস্তৃত।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পাঠকরা তাকে চিনেছেন নানারূপে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক, যার মধ্যে কবিতার বই প্রায় ষাট। সংখ্যার এই বিশালতা শুধু নয়, তার পরিশ্রম, একাগ্রতা ও সৃজনশীলতারও সাক্ষ্য বহন করে। কবি হিসেবে যেমন তিনি পরিচিত, তেমনি সফল সাংবাদিকও। দেশের একাধিক শীর্ষ দৈনিকে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর সম্পাদক। পাশাপাশি জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তার কাজের ক্ষেত্র শুধুই সাহিত্য বা সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ নয়-তিনি সংস্কৃতির সংগঠক, সম্পর্কের বন্ধনে সমৃদ্ধ, প্রাণবন্ত একজন মানুষ।
হাসান হাফিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা ও সরল বাণীপ্রকাশ। জটিলতার ঘেরাটোপ এড়িয়ে তিনি কবিতায় বলেছেন সরাসরি কথা। কবিতা তার কাছে শুধু শব্দের খেলা নয়, বরং ধ্যান, প্রেম ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফল। তাই কবিতার সাথে তার সম্পর্ক গভীর ও নিবিড়।
কবি হাসান হাফিজের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কাব্যিক সৌন্দর্য, বিমূর্ত প্রতীক এবং চিত্রকল্পের জাদুকরী ব্যবহার। তার কবিতায় ভাষা হয়ে ওঠে নিজেই একটি বাস্তবতা। প্রেম, নিঃসঙ্গতা, সময় ও অস্তিত্বের সঙ্কট-এই সব বিষয় তার কবিতায় ঘন আবহে এসেছে। আত্মানুসন্ধান ও দার্শনিক প্রশ্নমালা তার কাব্যচিন্তার কেন্দ্র। তার কবিতায় বহু সময় এক ধরনের অলৌকিক বাস্তবতার আবেশ দেখা যায়, যা পাঠককে ধীরে ধীরে আবিষ্ট করে।
কখনো তার কবিতা অতিমাত্রায় বিমূর্ত হওয়ায় সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। সমাজ বা রাষ্ট্র বিষয়ে সরাসরি বক্তব্য তার তুলনামূলকভাবে কম। তিনি লিখেছেন-
‘সময়ের ধুলোমাখা পৃষ্ঠায় আমি লিখি/ নিঃশব্দ ভালোবাসার উপাখ্যান / যেখানে তোমার নামটাই ছিল প্রশ্নবোধক চিহ্ন’- এটি প্রেম ও বেদনার ভেতরে থেকেও কবিতার গূঢ় অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে।
‘নিঃসঙ্গতার ভাষা’য় তিনি লিখেছেন- ‘নিঃসঙ্গতা একটি ভাষা / কেউ বোঝে না / শুধু রাতজাগা দেয়াল জানে...’ এখানে রয়েছে- একাকিত্ব, আত্মবিচ্ছিন্নতা, অনুভূতির নিঃশব্দ বিস্তার। এটি তার অন্যতম বিখ্যাত কবিতা, যেখানে নিঃসঙ্গতা এক ব্যক্তিগত মানসিক ভূগোল হয়ে ওঠে। এর ভাষা নির্মোহ, তবুও আবেগে ছায়াময়।
ভালোবাসা একটি গোপন বিপ্লব- এ তার উচ্চারণ- ‘তোমাকে ভালোবাসা মানে / নিজের ভেতরের রাষ্ট্র ভেঙে ফেলা...’ এখানে রয়েছে- প্রেম ও বিপ্লবের অন্তর্গত সংযোগ। ভালোবাসাকে এখানে তিনি একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করেছেন-যা সমাজের সব নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়ায়।
আমি একটি স্থবির যন্ত্রণার নাম- এ হাসান হাফিজ লিখেছেন- ‘ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলেও / আমার যন্ত্রণার সময় চলে যায় না...’ এখানে মূর্ত হয়েছে অস্তিত্বের সঙ্কট, সময়ের অসাড়তা। এই কবিতায় হাসান হাফিজ যেন সময় ও আত্মার গভীর চূর্ণ বিচূর্ণতার দলিল লিখেছেন। কবিতাটি আবেগপ্রবণ ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর।
তৃতীয় চোখের অন্ধকার- এ আত্মদর্শন, সচেতনতার ভার তার মূল থিম। তিনি দর্শন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বকে কবিতায় তুলে ধরেছেন অসাধারণ কাব্যভাষায়। এখানে প্রতীকীতা অত্যন্ত শক্তিশালী।
কোনো এক ভবিষ্যৎ তোমার নামে লেখা ছিল কবিতায় তার উচ্চারণ ছিল- ‘হয়তো একটা ইতিহাস লেখা হতো / যদি তুমি থেমে যেতে / আমার দিকের বাতাসে...’
হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনা, নিয়তি ও সম্পর্ক এখানে তার মূল বিষয়। কবিতাটি সময়ের ভাঙা আয়নায় সম্পর্কের সম্ভাব্য পথ রচনার এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
হাসান হাফিজের সেরা কবিতাগুলো মূলত এক অন্তর্মুখী যাত্রা, যেখানে পাঠক নিজের ভেতরের নিঃসঙ্গতা, প্রেম, ক্ষয় ও অস্তিত্বকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। তার কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা যেন শব্দের নীরব সঙ্গীত।
হাসান হাফিজের একবারেই সাম্প্রতিক একটি কবিতা- ‘মুগ্ধ জেগে আছি’। প্রতিবাদ, মানবিকতা ও রাজনৈতিক চেতনার এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটেছে হাসান হাফিজের এই কবিতায়। তার কবিতাটি সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক করুণ অথচ গৌরবময় অধ্যায়কে ধারণ করে-যেখানে মুগ্ধ নামের এক তরুণ আন্দোলনকারীর আত্মত্যাগ সংগ্রামী প্রজন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কবিতাটি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-যুব আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত।
এতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো মুগ্ধ হয়ে ওঠেন শহীদ তরুণ প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি। তার শেষ উচ্চারণ- ‘পানি লাগবে, পানি?’-আজ আন্দোলনের বেদনাবাহী প্রতীক।
এটি শুধু একটি শোকগাথা নয়; এটি প্রতিরোধ, প্রেরণা ও পুনর্জাগরণের কবিতা। এই কবিতায় হাসান হাফিজের ভাষা সংক্ষিপ্ত, দৃঢ় ও হৃদয়বিদারক-যা পাঠককে কাঁদায়, আবার সাহসী করে তোলে। এই কবিতার শক্তি সরল অথচ গভীর উচ্চারণ; যেখানে ব্যক্তিগত বেদনা পরিণত হয়েছে জাতীয় চেতনার অংশে।
‘বল ভরসা দাও রে দয়াল’ হাসান হাফিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্য। বইয়ের শিরোনামের কবিতাটি একটি গভীর আর্তি ও আত্মশুদ্ধির উচ্চারণ। কবিতাটির ভাষায় আছে আধ্যাত্মিক ব্যথা, জীবন-অন্বেষা। এতে তিনি লিখছেন-
অঘোরে ঘুমিয়ে থেকে অস্তমিত অবসিত হয়ে এলো প্রায়/জীবনের সিংহভাগ সময়-পরিধি। অসময়ে জেগে উঠে/ লাভ-ক্ষতি নির্ণয়ের চেষ্টা ও প্রয়াস ঠিক কতটা সফল হবে/ বুঝি না দয়াল। পরিস্থিতি এত বেশি ঘোলাটে দুর্গম আর/ জটিল বিভ্রান্তিকর-জাগরণ ও নিদ্রার পার্থক্য আমি কিছুতেই/ মেপেজুকে নিজের আয়ত্তে বৃত্তে মুঠোমধ্যে আনতে পারি না/ কে আমি কিসের আমি অধ্যাত্ম-খোঁচায় হই জেরবার/
তিনি আরো লিখেছেন- এত নিদ্রা পাপ আমি সহ্য করতে অপারগ, পুনরায় জেগে উঠতে চাই/ তুমি যদি একটু তাকাও নিচে, এই ভাঙা বুকের জমিনে তবে বল ভরসা পাই
নিদ্রা থেকে জাগরণ, বেদনা থেকে প্রার্থনা, আর অবসাদ থেকে পুনর্জন্মের আকুতি। গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ও আত্মঅন্বেষী এই কবিতায় জীবনের অবসাদ, ভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার ভেতর থেকে মুক্তি ও পুনর্জাগরণের আকুতি প্রকাশ করেছেন কবি। ‘দয়াল’ শব্দটি তিনি প্রকাশ করেছেন একদিকে দয়াময় স্রষ্টার প্রতীক, অন্যদিকে তা মানুষের ভেতরের এক অন্তর্লীন শক্তি বা চেতনার জাগরণকেও ইঙ্গিত করতে পারে। কবিতায় সময়, মৃত্যু, জীবন, ভ্রম, কুহক, নিদ্রা-এসব প্রতীক ব্যবহার করে অস্তিত্ব সঙ্কট ও মুক্তির আকাক্সক্ষা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি আধ্যাত্মিক সাধনা ও আধুনিক মানবিক বেদনার এক অপূর্ব মিশ্রণ। এর ভাষা ঘন, দার্শনিক ও রূপকে পূর্ণ।
‘অঘোরে ঘুমিয়ে থেকে অস্তমিত অবসিত হয়ে এলো প্রায় জীবনের সিংহভাগ’-এখানে সময়ের ক্ষয় ও মৃত্যুর ছায়া অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে প্রকাশিত। ‘ভবগাঙে ডুবোচরে লতানো কুহক’ চিত্রকল্পে কবিতায় জীবনকে বিভ্রান্তির নদীতে ডুবে যাওয়া চরের মতো দেখানো হয়েছে। ‘ভেদরেখা মুছে যায় জীবন-মৃত্যুর’- অস্তিত্বের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার দার্শনিক ধারণা। ‘পাষাণপুরী আন্ধাইরা বিবর’- অন্ধকার, পাপ ও মায়ার প্রতীকী কারাগার। এইসব চিত্রকল্পে কবি স্পষ্টতই অস্তিত্ববাদী বেদনাকে আধ্যাত্মিক মুক্তির সাথে যুক্ত করেছেন।
এই কবিতার শক্তি হলো-অভ্যন্তরীণ আবেগের তীব্রতা, প্রতীকী রূপকল্প, এবং সময়-জীবন-মৃত্যু-আধ্যাত্মবাদকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলার প্রয়াস। এটি এমন একটি কবিতা, যেখানে ব্যক্তিগত আর্তি এবং সর্বজনীন সত্য মিলেমিশে গেছে। পাঠকের কাছে এটি শুধু প্রার্থনা নয়, বরং অস্তিত্বের গভীর প্রশ্ন উসকে দেয়। কবিতাটি আধুনিক গদ্যকবিতার এক শক্তিশালী উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
হাসান হাফিজের ‘দানবের আছর হয়েছে’ আরেকটি শক্তিশালী কবিতা। এখানে তিনি লিখছেন-দানবের আছর হয়েছে কীভাবে কেমন করে অপ্রাপ্তির নকশিকাঁথা বুনতে হয়/ আঁধারসময়ে ভ্রান্ত চরাচরে নিরাসক্ত নির্লিপ্তি যে কীভাবে সম্ভব/ ইশারা ইঙ্গিত কিছু পারলে এই অভাগায় ছুঁড়ে দাও প্রভু.../ প্রগতির আলো-ভরসা আরো আরো বহু দূর, রেখাভাসও নাই/ মানুষের মেল-এ থেকে কত আর দেখতে হবে পচন ক্ষরণ হত্যা ধ্বংস লুটতরাজ যৌনবিকৃতির ঘৃণ্য আচার-সংস্কৃতি/ ক্রসফায়ারের নাট্য গল্পগাছা শুনতে শুনতে পচে গেছে কান
তিনি আলো লিখেছেন- দেখতে হয় নুসরাতেরা প্রতিবাদ করলেই পিশাচেরা সদম্ভ সনখ,/ ষড়যন্ত্রে পুড়ে ছাই ভস্ম হয়, প্রতিরোধ নিন্দাঝড় ন্যাতানো দুর্বল/ মানুষেরা বিচার বিবেকহীন লজ্জা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নাই/ মানুষেরা ‘মানুষ’ নামের যোগ্য সত্যি বলতে আছে কী আদৌ?/ মানুষেরা ‘শ্রেষ্ঠ জীব’ এই দাবি কোন্ মুখে করতে পারবে আর?/ মানুষেরা ‘সুকুমার’ নয় মোটে, দানবস্বভাব পুরা আছর করেছে
এই কবিতায় কবি মানুষ ও সমাজের বর্তমান দুরবস্থা, নৈতিক অবক্ষয় এবং নৃশংস বাস্তবতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন। কবিতার পরতে পরতে আছে অত্যাচার, লুটতরাজ, হত্যার সংস্কৃতি, যৌন বিকৃতি, ক্রসফায়ারের ভয়াবহতা, এমনকি নুসরাতের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠ দমন করার ঘটনাও। এসব চিত্র সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে সামনে আনে। কবি এখানে মানুষকে প্রশ্ন করেছেন- মানুষ কি আদৌ ‘মানুষ’ রইল? নাকি তারা কেবল দানবের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
কবিতার ধ্বনি হলো বিরাট হতাশা ও ঘৃণা, যেখানে আশা ও প্রগতির আলোকে ‘আরো বহু দূর’ বলে দূরবর্তী ও প্রায় অদৃশ্য করে তোলা হয়েছে। ‘দানবের আছর’ প্রতীকের মাধ্যমে মানুষের অমানবিক রূপটি দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই প্রতিবাদী কবিতায়। যেখানে নৈতিক মূল্যবোধের পতন ও সমাজের ভেতরের দানবীয় চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। পাঠকের মনে এটি অস্বস্তি জাগায়, কিন্তু সেই অস্বস্তিই আসল বার্তা-মানুষের ভেতরকার দানবকে চেনা ও প্রতিরোধ করা।
একই কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম কবিতা জন্মেছিলাম ভুল সময়ে। বুকের মধ্যে মোচড় দিলে/ ধরা পড়লে লজ্জিত হই/ এই বয়সে এসব মানায়?/ বয়স টয়স কিচ্ছু না ভাই/ মনের বয়স একই থাকে।/ জ্বর কাঁপুনি হৃৎপিণ্ডের/ ঐশী তানে মূর্ছনা পায়। কবিতার এই লাইনগুলো পড়লে প্রথমেই যে অনুভূতিটি আসে, তা হলো এক ধরনের গভীর আত্মসমীক্ষা, হতাশা আর অস্তিত্বের বেদনাভরা স্বীকারোক্তি। কবিতাটি মূলত এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ও আত্মসমালোচনা। জীবনের ভাঙা স্বপ্ন, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, সম্পর্কের অপূর্ণতা, আর সময়ের সাথে অসামঞ্জস্যের আক্ষেপ-সবকিছুর মিশ্রণে এখানে তৈরি হয়েছে এক ধরনের আত্মজৈবনিক কাব্যিক মোনালগ। ‘ভুল সময়ে জন্মেছি’- এই পুনরুক্তিটি যেন জীবনের বেদনাকে একটি চিরস্থায়ী লাইন দিয়ে বেঁধে দেয়।
কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে রয়েছে সম্পর্কের ক্ষয় ও অপূর্ণতার বেদনা। ‘খুঁজতে খুঁজতে পাই তোমাকে/হারিয়ে ফেলি’-এই লাইনগুলোতে আছে এক ধরনের অস্থির সন্ধান ও বারবার হারানোর যন্ত্রণা। ‘আপন ছায়াই’-এর কাছে ফিরে আসা মানে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাওয়া। এই স্তবকে নিঃসঙ্গতা ও বঞ্চনা প্রকট হয়ে ওঠে। শেষ অংশে কবি আত্মস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। ‘ভুল পাত্রেই দান করেছি/হৃদয়পদ্ম আর্তি আবেগ’-এটি এক ধরনের আত্মদোষারোপ, যেখানে জীবনের সমস্ত শ্রম, প্রেম, ত্যাগ যেন বৃথা গেছে। ‘জীবনচিতায় মরণশান্তি/নিভছে এবং জ্বলছে একা!!’ লাইনটি সবচেয়ে তীব্র। এখানে অস্তিত্বের ক্লান্তি, একাকীত্ব, আর মৃত্যুর আকাক্সক্ষার এক মিশ্র অনুভূতি রয়েছে।
তিনটি পর্বে সাজানো এই কবিতায় আবেগের ধাপে ধাপে গভীরতা তৈরি হয়েছে। সহজ কিন্তু আবেগপূর্ণ; ‘মনের বয়স’, ‘আপন ছায়া’, ‘জীবনচিতায়’ ইত্যাদি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার কবিতাকে মরমি করেছে। ‘ভুল সময়ে জন্মেছিলাম’ এই পুনরাবৃত্তি কবিতাকে একটি মর্মভেদী পুনরধ্বনি দিয়েছে।
এটি হাসান হাফিজের একটি অস্তিত্ববাদী কাব্যধারার কবিতা, যেখানে জীবনের অপূর্ণতা, ভুল সময়, ভুল বিনিয়োগ, আর ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা একসাথে গেঁথে গেছে। পাঠকের মনে এটি এক ধরনের গভীর বেদনাবোধ জাগায় কিন্তু একইসাথে আত্মসমীক্ষার তাগিদও দেয়।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা-ছিঁড়ে ফ্যালো, মুক্ত হও একটি অসাধারণ কবিতা মনে হয়। এখানে তার উচ্চারণ- মন পোড়ে, ধোঁয়া নেই/ মনের ভিতর জ্বলে, কিন্তু কোনো আলো নেই।/ মনের আকাশে মেঘ, তার কোনো ছায়া নেই।/ এত নেই, কেন নেই, মন লুপ্ত আকাশেই।/ দূরাকাশই মনের আবাস, ঝড়ে জলে দীর্ঘশ্বাস।/
কবি আরো বলছেন- মন পোড়ে, শব্দহীন/ আমি কেন জব্দ হই, বিরহের সুচে বিঁধে স্তব্ধ হই/ এই কষ্ট হয়তো তুচ্ছ সামান্যই-/ তাও কেন দূরের বাসিনী কোনো স্বৈরিণীর/ মনও কেন একইসঙ্গে পোড়ে/ বিচ্ছেদের আত্মঘাত অন্তহীন ঘোরে/ হায় রে মন, হায় পোড়া মন/ মিছেমিছি হও তুমি উচাটন, ছিঁড়ে ফ্যালো জীবনবন্ধন!
কবিতাটি পড়লে মনে হয় যেন এক নিঃশব্দ অভ্যন্তরীণ আর্তনাদ-যেখানে দুঃখ, বিরহ আর মুক্তির আকাঙ্খা একসাথে জমাট বেঁধেছে।
কবিতাটি মূলত মনের যন্ত্রণা, ক্লান্তি আর মুক্তির চূড়ান্ত আকাক্সক্ষাকে কেন্দ্র করে লেখা। বারবার ‘মন পোড়ে’ বা ‘মিছেমিছি হও তুমি উচাটন’-এর মতো লাইনে যে হতাশা ও ক্লান্তি ফুটে উঠেছে, তা এক ধরনের আধ্যাত্মিক বা অস্তিত্ববাদী বেদনার প্রকাশ। ‘মন পোড়ে, ধোঁয়া নেই / মনের ভিতর জ্বলে, কিন্তু কোনো আলো নেই’-এখানে কবি অদৃশ্য আগুন ও আলোহীন জ্বলার প্রতীক ব্যবহার করেছেন।
‘মনের আকাশে মেঘ, তার কোনো ছায়া নেই’-অদ্ভুত অথচ শক্তিশালী ইমেজ; মেঘ থাকলেও ছায়া নেই মানে অস্থিরতা আছে কিন্তু তার পরিণাম নেই। ‘বিরহের সুচে বিঁধে স্তব্ধ হই’-এখানে সুচে বিঁধার চিত্রকল্পটি গভীরভাবে তীক্ষè ও বেদনাদায়ক। কবিতার শেষাংশে, ‘ছিঁড়ে ফ্যালো জীবনবন্ধন!’-এটি কেবল মুক্তির আকাক্সক্ষা নয়, এক ধরনের আত্মমুক্তির ডাক। যেন বেদনাকে অতিক্রম করে এক নতুন অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা খোঁজা। এটি এমন এক ধরনের অন্তর্গত বিদ্রোহের কবিতা, যেখানে কবি কষ্ট থেকে পালানোর নয়, বরং বন্ধন ছিঁড়ে মুক্ত হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
আমরা হাসান হাফিজকে যারা কাছ থেকে দেখি তারা একজন মিষ্টিভাষী, সহজ-সরল ও পরোপকারী মানুষ হিসাবে পাই। সাহিত্য-সাংবাদিকতার পরিমণ্ডলে এই উষ্ণ সম্পর্ক রক্ষার ক্ষমতা তাকে অনন্য করে তুলেছে। ১৫ অক্টোবর ২০২৫ কবি হাসান হাফিজের ৭১তম জন্মদিন। সাত দশক অতিক্রম করেও তিনি আজও সমানভাবে সক্রিয়, পরিশ্রমী ও প্রাণবন্ত। অনেক শুভেচ্ছা তার এই আগমন দিনে। তার ভুবন ভরে উঠুক আনন্দ ও সৃজনশীলতার আলোয়।