মুনাফার নামে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো

অন্ধকারে বাংলাদেশ ব্যাংক

নামমাত্র মূলধন এনে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়; কিন্তু কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নেয়া হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া মুনাফা নেয়া যেত না; কিন্তু পতিত সরকারের শেষ পাঁচ বছরে ব্যাপক ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা শিথিল করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এর পর থেকেই ব্যাপক ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশসহ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মুনাফার নামে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। নামমাত্র মূলধন এনে স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়; কিন্তু কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নেয়া হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। এর ফলে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ পাঠানোর ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে হতো। পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে যে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছিল তা যথাযথ ছিল কি না, আয়ের একটি নির্ধারিত অংশ কর পরিশোধ করেছে কি না, প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পরিস্থিতি কী এসব বিষয়ে যাচাই-বাছাই করত বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো অসঙ্গতি শনাক্ত হলে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ থেকে সমন্বয় করা হতো; কিন্তু ২০২০ সালের ৭ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ মুনাফা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে অন্ধকারে থেকে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

যেসব বিষয় যাচাই-বাছাই করত বাংলাদেশ ব্যাংক : এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ মুনাফা করবে আর সে অনুযায়ী যে পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করবে তার ওপর ব্যক্তিক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। এসব ট্যাক্স ঠিকমতো পরিশোধ করা হয়েছে কী না তা যাচাই-বছাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স পরিশোধের চালান দেখা হতো। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলো করপোরেট কর পরিশোধের বিষয়েও যাচাই-বাছাই করা হতো।

আয়কর আইন-২০২৩-এর ধারা ২৪৪ এবং ধারা ২৫১-এর অধীনে বাংলাদেশ সরকার দ্বৈত কর এড়াতে এবং আর্থিক ফাঁকি রোধ করতে অন্যান্য দেশের সাথে ডিটিএএ চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সরকার ৩৬টি দেশের সাথে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে রয়েছে- অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম-লুক্সেমবার্গ অর্থনৈতিক ইউনিয়ন, কম্বোডিয়া, চীন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, ইতালি, জাপান, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, মালয়েশিয়া, নেদারল্যান্ডস, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনাম। আয়কর নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত আলোচ্য দেশের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স-সুবিধা নিতে গেলে এনবিআরের আন্তর্জাতিক উইং থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। লভ্যাংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এনবিআরের ছাড়পত্র নিয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ দিকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ মুনাফা করে তা যথাযথভাবে করা হয়েছে কি না তার জন্য নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সনদ নিতে হয়। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বছর শেষে লভ্যাংশ নেয়ার ক্ষেত্রে নিরীক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সনদ নিয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করত বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অতীত নিরীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান তাদের ভুয়া আয় দেখাত। পাশাপাশি খরচ কম দেখাত। বিভিন্ন প্রভিশন ঠিকমতো রাখা হতো না। আবার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের নির্ধারিত হারে প্রভিডেন্ড ফান্ড বা কল্যাণ তহবিল রাখার বিধান রয়েছে। অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের কল্যাণ ফান্ড সংরক্ষণ না করেই বাড়তি মুনাফা দেখিয়ে তা বিদেশে নিয়ে যেত। এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অনেকসময় বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ মূলধন এনেছে বছর শেষে ভুয়া মুনাফা দেখিয়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ একধরনের সিন্ডিকেট নামমাত্র মূলধনে প্রতিষ্ঠান খুলে অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করত। এসব বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে তদারকি করা হতো। আবার অনেকসময় এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে জালজালিয়াতির মাধ্যমে বাড়তি অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যেত, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে একাধিক ঘটনা ধরাও পড়েছিল। যেমন বর্তমান প্রতি ডলারের মূল্য যেখানে ১২০ টাকা, সেখানে দেখানো হতো ১০০ টাকা। এর ফলে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যেত। আগে এসব বিষয়ে তদারকি করত বাংলাদেশ ব্যাংক।

আগে বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে নিজ দেশ থেকে মূলধন এনে ব্যবসা বাড়াতে হতো; কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া হয়। নানা ধরনের ট্যাক্স-সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করে নিজ দেশে বৈদেশিক মুদ্রায় মুনাফা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে প্রতিবেশী দেশের বিনিয়োগকারীরা। নামমাত্র মূলধন এনে বাংলাদেশে ব্যবসা করে বড় অঙ্কের মুনাফা বৈদেশিক মুদ্রায় নিজ দেশে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।

মুদ্রাপাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি শিথিল : বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে কর্মী পর্যন্ত যে যেভাবে পেরেছে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে। প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশে নির্বিঘ্নে অর্থ পাচার করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থপাচার বন্ধে সবধরনের পদক্ষেপ শিথিল করে দেয়া হয়। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে নীতিমালা শিথিলের হিড়িক পড়ে যায়। সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ডাকাত এস আলম, সালমান এফ রহমান, শেখ পরিবারের শীর্ষ মহল থেকেও এসব নীতিমালা শিথিলের নির্দেশনা আসত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। অনেকেই নিজেদের চেয়ার ঠিক রাখার জন্য ও পদোন্নতি পাওয়ার আশায় মাফিয়াদের নির্দেশনা সুবোধ বালকের মতো পালন করতেন। মুদ্রাপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা সবধরনের সুরক্ষা ভেঙে ফেলা হয়। তার বড় প্রমাণ হলো- বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর লভ্যাংশ নেয়ার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা শিথিল করা। ২০২০ সালের ৭ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগ থেকে এক সার্কুলারে বলা হয়, বিদেশী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাদের নিজ দেশে লভ্যাংশ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে আর অনুমোদন নিতে হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে যাচাই-বাছাই করত তাও করা লাগবে না। এ নীতিমালা শিথিল করায় মুনাফার নামে বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে সে বিষয়ে অন্ধকারে পড়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে আবারো উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশসহ মাফিয়ারা যেন নির্বিঘ্নে অর্থ পাচার করতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের মতো যাচাই-বাছাই করতে হবে। অন্যথায় অর্থপাচার কোনোভাবেই বন্ধ হবে না; বরং বেড়ে যেতে পারে।