গর্ভকালীন একটি জটিলতার নাম প্রিএকলাম্পশিয়া। বাংলাদেশে প্রতি লাখে ৪৬ নারীর মৃত্যু হয় এই রোগে। এটা কোনো জীবাণু ঘটিত রোগ নয়, এটা হয়ে থাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানির কারণে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে প্রিএকলাম্পশিয়ার ঝুঁকি বেশি। সেখানে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। শুধু যে উপকূলীয় এলাকার গর্ভবর্তীরা ভুগছেন তা নয়, ঢাকা শহরের গর্ভবতীরাও এই রোগে ভুগছেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ থেকে ৩০ বছরে নিম্ন আয়ের এবং আগে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে প্রিএকলাম্পশিয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রিএকলাম্পশিয়া হলো গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত একটি জটিলতা, গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর দেখা দেয়। এটি মা ও অনাগত শিশুর উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না নিতে পারলে মা ও শিশু উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
পাবমেডে প্রকাশিত অনন্যা দত্ত মৌ জিতু রহমান, মাহমুদুল হাসান, রাকিব মিয়া, জেসিয়া মুমতাহিনা হাফসা, অপরাজিতা দাস তৃষা, নুর পরিচালিত একটি দল ১১১ জনের মধ্যে গবেষণা করে দেখেছেন যে ১৪.৪ শতাংশ গর্ভবতী প্রিএকলাম্পশিয়ায় ভুগছে। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ গর্ভবতী প্রিএকলাম্পশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন গর্ভের ২০ সপ্তাহের পর। এই গর্ভবতীদের আগে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস নেই।
গবেষকরা বলেন, এই রোগের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, এটি প্লাসেন্টার বিকাশে সমস্যা, রক্তনালীর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার অসামঞ্জস্যতা থেকে সৃষ্টি হতে পারে। কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় যেমন প্রথমবার গর্ভধারণ, যমজ সন্তান, অতিরিক্ত ওজন, পরিবারে প্রিএকলাম্পশিয়ার ইতিহাস এবং দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ রোগ এই অবস্থার ঝুঁকি বাড়ায়। প্রিএকলাম্পশিয়ার সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ (১৪০/৯০ মিমি বা এর বেশি), মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, পেটের ওপরের ডান পাশে ব্যথা, হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে যাওয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো অনুপস্থিতও থাকতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, সে কারণে নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শে থাকতে হবে।
গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা: শারমিন সুলতানা বলেন, প্রিএকলাম্পশিয়া প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রক্তচাপ মাপা, প্রস্রাবে প্রোটিন পরীক্ষা করা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি। রোগটি মারাত্মক হলে (অর্গান ফেলিওর হওয়ার আশঙ্কা থাকলে) গর্ভকাল পুরো না হলেও সন্তান প্রসবই একমাত্র সমাধান হতে পারে।
প্রিএকলাম্পশিয়ার প্রতিরোধে গর্ভাবস্থায় সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন। যারা ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যাসপিরিন বা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ উপকারী হতে পারে। সার্বিকভাবে, প্রিএকলাম্পশিয়া একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সময়মতো শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রত্যেক গর্ভবতী নারীর উচিত নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপ করা এবং যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন গর্ভবতী নারীর প্রথমবার সন্তান ধারণের সময়ই প্রি-একলাম্পশিয়া হতে পারে আর যাদের আগের সন্তান ধারণের সময় প্রি-একলাম্পসিয়া হয়েছিল, তাদের ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে পুনরায় এটি হতে পারে।
প্রি-একলাম্পসিয়া মারাত্মক পর্যায়ে গেলে খিঁচুনি হয়, এমন হলে মাতৃ ও শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এ ছাড়া কম ওজনের শিশুর জন্মদান, সময়ের আগে প্রসব, মাতৃগর্ভে শিশুমৃত্যু, এন্টিপারটাম হেমোরেজ ইত্যাদি সমস্যা প্রি-একলাম্পসিয়ায় আক্রান্ত মায়েদের ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এর জটিলতা হিসেবে কিডনি ও লিভার ফেইলিউর কিংবা ব্রেন হেমোরেজও (ব্রেনে রক্তক্ষরণ) হতে পারে। কিছু রোগীর শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণসহ অন্যান্য জটিলতা হয়।