সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে বিএনপি

রাষ্ট্র সংস্কারে গত ৯ মাসের যে প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মতৈক্যের ভিত্তিতে তৈরি সনদ কোনোভাবেই যাতে বিফলে না যায় সেজন্য সরকারকে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো জবরদস্তি না করে, কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করতে হবে বলেও স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে দলটি।

মঈন উদ্দিন খান
Printed Edition

জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে নতুন করে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান চায় বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই মতানৈক্য নিরসন করবেন বলে আশা করছে দলটি।

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারে গত ৯ মাসের যে প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মতৈক্যের ভিত্তিতে তৈরি সনদ কোনোভাবেই যাতে বিফলে না যায় সেজন্য সরকারকে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো জবরদস্তি না করে, কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করতে হবে বলেও স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে দলটি।

নেতারা বলেছেন, কয়েকটি পক্ষ বিএনপি সংস্কার চায় না এমন প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিয়েছে। অথচ বিএনপিই সংস্কারের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। রাষ্ট্রসংস্কার তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা কখনোই সরে আসবে না।

আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সে সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচনটা হোক, সেটাই চায় বিএনপি। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট রাজনৈতিক দল। দাবি আদায়ে জামায়াত ইতোমধ্যে কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে। তবে এই ইস্যুতে বিএনপি এই মুহূর্তে পাল্টা কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। দলটি এমন কোনো অবস্থান নিতে চায় না, যাতে করে ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ আলোচনায় অর্জিত অগ্রগতি ভণ্ডুল হয়ে যায়। দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতে এর সফল সমাপ্তি চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, মতভেদ থাকলেও জুলাই সনদে তারা ইতোমধ্যে স্বাক্ষর করেছে এবং এর আইনি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছে।

বিএনপি মনে করছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন যৌক্তিকভাবে একই দিনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে। এর স্বপক্ষে গতকাল দলের মিডিয়া সেলে এক পোস্টে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা যৌক্তিক, সাশ্রয়ী ও বাস্তবসম্মত। জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো ভোট আয়োজন কঠিন। কারণ গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি জাতীয় নির্বাচনের মতোই ব্যাপক। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট সম্ভব। জাতীয় নির্বাচনের দিনে প্রত্যেক ভোটারকে দু’টি ব্যালট দিলেই গণভোটও সম্পন্ন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই; শুধু ব্যালট পেপার ছাপানো ও ভোটকেন্দ্রে কিছু অতিরিক্ত কক্ষ সংযোজন করলেই যথেষ্ট। তা ছাড়া একই দিনে দু’টি ভোট সম্পন্ন করা গেলে সরকারের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বাঁচবে। দলটি এ-ও মনে করছে, আগে গণভোট করলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর নির্বাচন পিছিয়ে গেলে গণ-অভ্যুত্থানের যে আকাক্সক্ষা, সেটাও ব্যাহত হতে পারে। কারণ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পক্ষ বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করে দিতে ওঁত পেতে রয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়াই যৌক্তিক।

দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থেকে যায়। এমন অবস্থাতেই গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা তুলে দেন। সরকারকে সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পরপর দুই দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। নেতারা মতামত দেন যে, যেসব সংস্কার প্রস্তাবে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে সেটা রাখা হয়নি। বিএনপি এটিকে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতারণা বলছে। তবে দলটি এমন কোনো অবস্থান নিবে না, যেখানে ‘বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে কিংবা বিএনপি সংস্কার চায় না’-এটা প্রতিফলিত হয়। এ কারণে সুপারিশ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ থাকলেও সেটি প্রত্যাখ্যান করেনি। কারণ প্রত্যাখ্যান করলে নির্বাচন বানচালের অজুহাত তৈরি হতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ নিতে পারে। বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের দল হিসেবে ইতোমধ্যে উপস্থাপন করা হচ্ছে; কয়েকটি রাজনৈতিক দল এটা বার বার ব্র্যান্ডিং করতে চাচ্ছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার বাস্তবায়নে বিএনপি হচ্ছে সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। তারা বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চায় এবং এটা তাদের অঙ্গীকারও। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংস্কার উদ্যোগের অনেক আগে থেকেই তারা সংস্কারের প্রসঙ্গটি সামনে এনেছে। এর অংশ হিসেবে তারা ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি দিয়েছে। ক্ষমতায় গেলে যেটি তারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে।

এ দিকে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে কমিশনের সুপারিশের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে সুপারিশকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সুপারিশে যেসব বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়নি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সব সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই সব সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

বিএনপি মনে করে, দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর আলোকেই জুলাই সনদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আর যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখতে পারে। জনগণ তাদেরকে সমর্থন জানালে পরে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মতভেদ থাকলেও মূল যে সনদ, সেই সনদে আমরা স্বাক্ষর করেছিলাম। এটাই নিয়ম যে, আমরা যদি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাই, মানুষ যদি আমাদের ভোট দেয়, তাহলে আমরা সেই বিষয়গুলো আবার সামনে নিয়ে আসব। সেটাকে আমরা পার্লামেন্টে পাস করে দেশের যে পরিবর্তন, সেই পরিবর্তনটা নিয়ে আসব।