২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট)। তখনো পালিয়ে যাননি স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। সরকারের দেয়া কারফিউ উপেক্ষা করে মার্চ টু ঢাকা সফল করতে রাজধানীতে ঢল নামে মানুষের। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখ লাখ মানুষ ঢুকতে শুরু করে ঢাকায়। নানা মহলে গুঞ্জন শুরু হয় শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই সময়ও থেমে থাকেনি পুলিশ। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। এমনকি হাসিনা বিদায় নেয়ার পর ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাসেও গুলি চালানো হয়। এসব গুলিতে সারা দেশে কমপক্ষে ২০ জন নিহত হয়। আহত হয় কয়েক হাজার। বিশেষ করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, ইসিবি চত্বর, রামপুরা, ঢাকার বাইরে আশুলিয়া, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহসহ অনেক জেলায় এমন ঘটনা ঘটে। তবে সেদিনে পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালিয়েছে বলে শোনা যায়নি।
৩৬ জুলাই ২০২৪ এর পর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। জানা গেছে, ভোর থেকে পথে পথে পুলিশের গুলি, টিয়ার শেল উপেক্ষা করে জনতা জড়ো হতে থাকেন ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে। আবার কেউ কেউ আগের দিন রাতেই ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে রওনা করেন।
সেদিন সরকার ঘোষিত কারফিউ চলার মধ্যে ছাত্র-জনতা সকাল থেকে মাঠে নেমেছিলেন। তাদের সাথে যুক্ত হতে থাকেন ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে আসা হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। কারফিউ উপেক্ষা করেই তারা জড়ো হতে থাকেন রাজধানীর প্রতিটি এলাকায়। এ সময় পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তবু রাজপথ ছাড়েননি একজনও।
সবাই অপেক্ষায় ছিলেন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া সেনাপ্রধানের ভাষণের জন্য। কিন্তু পুলিশ তাদের রাস্তা থেকে তুলে দিতে গুলি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাসেল (২৮), সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন (২৪), তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান (২২), অজ্ঞাত (২৭), সাইফুল ইসলাম তন্ময় (২২), প্রবাসী আবু ইসহাক (৫২) ও আজমত মিয়া (৪০), পূবালী ব্যাংকের স্টাফ মানিক মিয়া (২৭) ও অজ্ঞাত (২৫) একজন নিহত হন। তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
সেদিন সরেজমিন মিরপুর গিয়ে দেখা যায় মিরপুরের সব রাস্তা যেন ১০ নম্বর গোল চত্বরে গিয়ে মিশেছে। কাজীপাড়া থেকে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর, মিরপুর-১ নম্বর থেকে ১০ নম্বর, পল্লবী থেকে ১০ নম্বর আবার ১৩ ও ১৪ নম্বর থেকে ১০ নম্বরে শুধু মানুষ আর মানুষ। মাথায় লালসবুজের পতাকা বেঁধে পুরো রাস্তা দখল করে বসে আছে। পুলিশ কয়েকবার তাদের রাস্তা থেকে উঠানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। বেলা পৌনে ১টার দিকে আসিফ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, কারফিউ উপেক্ষা করে সকাল থেকেই তারা রাস্তায় অবস্থান করছেন। তবে জানতে পেরেছেন সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তার ভাষণের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সেখান থেকে মহাখালী রাওয়া ক্লাবের সামনে পৌঁছালে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা পুরো রাস্তা অবরোধ করে ভুয়া ভুয়া সেøাগান দিচ্ছেন।
অপর দিকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে কুড়িল, আবার রামপুরা বাড্ডা পুরো এলাকা ছিল ছাত্র-জনতার দখলে। মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তাও দখলে ছিল ছাত্র-জনতার। বেলা বাড়তেই তারা যাত্রা করেন শাহবাগের দিকে। এ দিকে রাজধানীর প্রবেশপথ আমিনবাজার গাবতলী, টঙ্গী, পোস্তগোলা দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে আশপাশের জেলার হাজার হাজার মানুষ।
‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির সাড়া দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে নেমেছিল জনস্রোত। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ঢেউয়ের গন্তব্য শাহবাগ। সকাল ১০টার আগে থেকে ঢাকার বাইরের নারায়ণগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে মানুষ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ঢাকার দিকে আসতে থাকেন। তবে এর আগে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা এলাকায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এখানেই পুলিশের গুলিতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। মুহুর মুহুর গুলির পরও হাজার হাজার মানুষের তোপের মুখে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ।
এ দিকে গত এক বছর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের বিরাট একটি অংশ বিজয় মিছিলের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পালানোর পর বাঁধভাঙা উল্লাস নিয়ে মিছিল বের করেন। ওই মিছিলেও নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। যে গুলিতে নিহত হন অনেকে। তবে বেশির ভাগই আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন।
জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। প্রথম সপ্তাহ রাজধানীর শাহবাগ ঘিরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। এরপর দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। বাড়তে থাকে প্রাণহানি। ছাত্রদের সাথে রাস্তায় নেমে আসেন সর্বস্তরের মানুষ। অবশেষে সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে ৪ জুলাই রাস্তায় নেমে আসেন ছাত্র-জনতা।