চিংড়ি রফতানি কমছে

ভেনামী চাষেও আশানুরূপ সফলতা আসছে না

২০১৪-১৫ সাল থেকে চিংড়ি থেকে রফতানি আয় কমছে। মাঝখানে ২০২১-২২ সালে ডলারের সাথে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আয় একটু বাড়তি দেখা যায়। কিন্তু এরপর থেকে আশঙ্কাজনকভাবে এ খাতের রফতানি আয় হ্রাস পাচ্ছে।

এরশাদ আলী, খুলনা ব্যুরো
Printed Edition

গার্মেন্টের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় খাত হয়ে উঠেছিল চিংড়ি রফতানি। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়া, অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা এবং পোনা সঙ্কটসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি রফতানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে রফতানি তালিকায় হয়েছে ব্যাপক অবনমন।

রফতানি ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ সাল থেকে চিংড়ি থেকে রফতানি আয় কমছে। মাঝখানে ২০২১-২২ সালে ডলারের সাথে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আয় একটু বাড়তি দেখা যায়। কিন্তু এরপর থেকে আশঙ্কাজনকভাবে এ খাতের রফতানি আয় হ্রাস পাচ্ছে। দেশের চিংড়ির ৮০ শতাংশই খুলনা অঞ্চলে চাষ এবং রফতানি হয়। বাকিটুকু হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে, মূলত কক্সবাজারে। অপর দিকে ভেনামী (চিংড়ি) চাষ করে চিংড়ি শিল্পকে রক্ষা করার যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল, পোনা সঙ্কটসহ আরো কিছু সমস্যার কারণে সেটাও আশা জাগাতে পারছে না।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ৭২৬, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৭০৬, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ১৬৪, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৩ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৬১৫, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৭১, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫ হাজার ১৪৩ মে. টন এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ১৯ হাজার ১৩১ মে. টন চিংড়ি রফতানি হয়েছে।

চিংড়ি শিল্পের সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএফএফই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, উপকূলীয় এলাকায় ঘেরে লবণ পানি ঢুকাতে প্রশাসন বাধা দিচ্ছে। নদ-নদী সিলট্রেটেড হচ্ছে, ঘেরের বেড উঁচু হয়ে যাচ্ছে। ফলে চিংড়ি চাষ কমছে। চিংড়ি চাষিদের সরকারিভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, বিদ্যুতের উচ্চমূল্য মিলিয়ে সঙ্কটে চিংড়ি চাষ। আর চিংড়ির ওজন বাড়াতে ব্যবসায়ীদের একাংশের অপদ্রব্য পুশ রফতানি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তবে চিংড়ি রফতানি কমে যাওয়ার পেছনে অপদ্রব্য পুশ বড় কারণ নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে ভৌগোলিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে নদী-খাল ও বিল-ঝিল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মৎস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চিংড়ি মৃত্যুহার বেড়ে গেছে। সাথে মজুরি বৃদ্ধি এবং ফিসফিড ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দাম বাড়ার ফলে চিংড়ির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় চিংড়ির দাম না বাড়ায় অনেক চাষিই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে সাদা মাছ চাষ করছেন। উৎপাদন কম হলে রফতানি কম হওয়া স্বাভাবিক।

অপর দিকে কয়েক বছর আগে ভেনামী চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথম দুই বছর পাইকগাছার লবণপানি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়। সেটার ফলাফল ইতিবাচক না হলেও চিংড়ি শিল্প বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বলা চলে মিডিয়ায় পজেটিভ প্রচারণা চালান হয়। তাতে ভেনামী চাষ আশাব্যঞ্জক বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। চিংড়ি শিল্পে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ কয়েকটি সূত্রে কথা বলে জানা যায়, এমনিতে স্থানীয় জাতের চিংড়ি পোনার সঙ্কট আছে। হ্যাচারিগুলো যা উৎপাদন করে তারপরও পোনার সঙ্কট থেকে যায়, যা প্রাকৃতিক আধার থেকে পূরণ করার চেষ্টা করা হয়। সেক্ষেত্রে ভেনামীর পোনা সঙ্কট আরো মারাত্মক। প্রথমে থাইল্যান্ড থেকে আনার ব্যবস্থা হয়। তার ফলে বিমানে ঢাকা ও তারপর সড়ক পথে ঘেরে পৌঁছাতে ১০ ঘণ্টাধিক সময়ের ভ্রমণে অনেক পোনা মারা যায় এবং যেগুলো বেঁচে থাকে; অসুস্থ হয়েই থাকে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে পোনা আনা হয়। দেশীয় হ্যাচারিতে ভেনামীর পোনা উৎপাদনের উদ্যোগও পুরোটা সফল হয়নি। এ ছাড়া ফিড সঙ্কট এবং ভেনামীর পরিচর্যায় অনভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।

এমতাবস্থায় কয়েক দশক ধরে বাণিজ্যিক চাষের পরেও স্থানীয় প্রজাতির চিংড়ি চাষে যেখানে একটি স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি, সেখানে খুবই অবাস্তব যে আমরা হঠাৎ করে ভেনামীতে সফল হতে পারব। অথচ ভেনামী এমন একটি প্রজাতি যার জন্য আরো কঠোর ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা (পড়সঢ়ষরধহপব) প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে খুলনা জেলা মৎস্য কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এ টি এম তৌফিক মাহমুদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমাদের স্থানীয় জাতের চিংড়ি চাষের সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের আশু কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর বিকল্প ভেনামী চাষের জন্য চাষিরা আবেদন করলে তাদের অবকাঠামো এবং পরিচর্যার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরেজমিন পরিদর্শনে সন্তোষজনক পাওয়া গেলে অনুমতি দেয়া হয়। তবে চাষিদের কেউ কেউ অনুমতি ছাড়াই পোনা সংগ্রহ করে ভেনামী চাষ করছেন। ভারতীয় পোনা চাষে একটা আশঙ্কা হচ্ছে, সেগুলো একধরনের ভয়ানক রোগে আক্রান্ত থাকতে পারে। স্থানীয়ভাবে পোনা উৎপাদন না হলে ভেনামী চাষে সফলতা আসবে না। দেশে তিনটি হ্যাচারিকে পোনা উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে কেবল কক্সবাজারের একটি পোনা উৎপাদন করছে।