যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক হ্রাসে ফিরছে অর্ডার

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে স্বস্তির হাওয়া, নতুন করে আসছে কোটি ডলারের অর্ডার

শাহ আলম নূর
Printed Edition

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতিতে সাম্প্রতিক শিথিলতা বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে নতুন গতি ফিরিয়েছে। দীর্ঘ অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এতে গত কয়েক মাস ধরে স্থগিত থাকা অর্ডারগুলো পুনরায় সক্রিয় হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “শুল্ক কমার ঘোষণার পর মার্কিন ক্রেতারা আবারো আমাদের রফতানিকারকদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন। যেসব অর্ডার ট্যারিফ অনিশ্চয়তার কারণে আটকে ছিল, সেগুলো আবার সচল হচ্ছে।” তবে তিনি সতর্ক করে দেন, “শুল্ক কমলেও বন্দর, কাস্টমস ও লজিস্টিক ব্যবস্থায় দক্ষতা না বাড়ালে এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাবে না। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।”

স্থগিত অর্ডারে গতি, নতুন আশার আলো : স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন বায়ার তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ তিন লাখ পিস পোশাকের অর্ডার স্থগিত করেছিলেন। ট্যারিফ হ্রাসের পর তারা আবারো অর্ডার চালুর কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বেশির ভাগ বায়ার বাড়তি শুল্ক নিজেরাই বহন করছেন। আমরা মূল্যছাড় দিতে রাজি নই। দাম বাড়লে কিছু ভোক্তা হারাতে পারি, তবু আমরা স্থিতিশীল মূল্য রা করতে চাই।”

ঢাকাভিত্তিক বায়িং হাউজ লিয়াং ফ্যাশন লিমিটেড জানায়, তাদের মার্কিন ক্রেতা সাউথপোল আবারো স্থগিত অর্ডার সক্রিয় করেছে। শুল্ক কমার দিনেই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৬ হাজার পিস লং প্যান্ট ও শর্টসের অর্ডার নিশ্চিত করেছে। অল্পদিনের মধ্যেই আরো একটি বড় অর্ডার আসবে বলে তারা আশা করছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ রফতানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ জানান, তাদেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ডার ট্যারিফ জটিলতায় আটকে ছিল। তবে এখন চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি, তবু তিনি আশাবাদী অর্ডারটি আর অন্য দেশে যাবে না।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে : চট্টগ্রামভিত্তিক এশিয়ান গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, টার্গেট ও ওয়ালমার্টের মতো বড় বায়াররা চালান স্থগিত করেননি। তবে নতুন অর্ডারে কিছু বায়ার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, “শুল্ক বৃদ্ধির সময় কিছু বায়ার ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় চেয়েছিলেন, যা আগে দেখা যায়নি। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের উৎপাদন খরচ অন্তত ১২ শতাংশ কমাতে হবে। এজন্য কারখানায় অটোমেশন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বাড়াতে হবে।”

ভ্যালু অ্যাডিশন ও কাঁচামাল সংযোজনের চ্যালেঞ্জ : যদিও নতুন ২০ শতাংশ ট্যারিফ চীনের ৩০ শতাংশ ও ভারতের ২৫ শতাংশের তুলনায় কম, তবে পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছেন না রফতানিকারকরা। অনেক ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের (ভ্যালু অ্যাডিশন) শর্ত দেয়া হতে পারে। এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “সব পণ্যে এত পরিমাণ মূল্য সংযোজন সম্ভব নয়। ফলে অনেক কারখানা সমস্যায় পড়বে।”

নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পোশাক উৎপাদনে যদি ২০ শতাংশ আমেরিকান কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তবে ওই অংশে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হবে না। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ পোশাক তুলা থেকে তৈরি। ফলে আমেরিকান তুলা আমদানি বাড়িয়ে শুল্ক চাপ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন এরই মধ্যে তুলা আমদানির পরিমাণ ৩০ কোটি ডলার থেকে ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে।

চীনের বিকল্প বাজারে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ : বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের সম্মিলিত শুল্ক প্রায় ৬৪ শতাংশ হওয়ায় অনেক ক্রেতা বিকল্প বাজার খুঁজছেন। ভিয়েতনামও চীনা কাঁচামালে নির্ভরশীল হওয়ায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা বাড়ছে। বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “চীনের রফতানি কমে যাওয়ায় আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেকোনো সময় আবারো শুল্ক হার বদলে দিতে পারেন, তাই সতর্ক থাকা জরুরি।”

সতর্ক আশাবাদ : বাজার বৈচিত্র্য ও দক্ষতা বৃদ্ধির আহ্বান : বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠন বলছে, মার্কিন বাজারে শুল্ক হ্রাস স্বস্তিদায়ক হলেও একক মার্কেট নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মতে, এই সুযোগ টেকসই করতে হলে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানো, মার্কিন ক্রেতাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক জোরদার করা এবং বহুমুখী বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে।