মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়নি, শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাথমিক গোয়েন্দা রিপোর্টের মূল্যায়নে এমনটি বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে নড়বড়ে একটি অস্ত্রবিরতি শুরু হওয়ার পর এমন তথ্য সামনে আসছে। এ দিকে গোপন গোয়েন্দা রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক পোস্টে ক্ষোভ জানান তিনি। রয়টার্স।
ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ভুয়া খবরের সিএনএন ডুবন্ত নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে মিলে ইতিহাসের অন্যতম সফল সামরিক অভিযানের গুরুত্বকে খাটো করে দেখাতে চাইছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে! টাইমস আর সিএনএন -দুই প্রতিষ্ঠানকে নিয়েই সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ!’ ট্রাম্পের ঘোষিত একটি অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে ইরান ও ইসরাইলকে তিরস্কার করার পর গত মঙ্গলবার উভয় দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে তাদের আকাশযুদ্ধ অন্তত এখনকার মতো হলেও শেষ হয়েছে।
১২ দিন ধরে টানা যুদ্ধ চলার পর দুই দেশ তাদের বেসামরিকদের ওপর জারি করা বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে। এই যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও যোগ দেয়। মার্কিন বাহিনী ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণ করে সেগুলো ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করে। রোববার ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৩ হাজার ৬০০ কেজির কয়েকটি বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘বিলুপ্ত’ করে দিয়েছে।
কিন্তু তার এই দাবি তার প্রশাসনের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক মূল্যায়নের সাথে যাচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে, বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাত তিন ব্যক্তি রয়টার্সকে এমনটি জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন বলেছেন, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ এবং দেশটির ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি। মার্কিন হামলায় এই কর্মসূচী সম্ভবত এক থেকে দুই মাসের মতো পিছিয়ে গেছে। ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বেসামরিক উদ্দেশ্যে নিয়োজিত।
তিনি জানান, মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে দু’টি পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে; কিন্তু ভূগর্ভস্থ ভবনগুলো ধ্বংস হয়নি। হামলার পর এখনও কিছু সেন্ট্রিফিউজ অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টটির বিষয়ে জ্ঞাত এক অজ্ঞাত ব্যক্তির বরাত দিয়ে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
হোয়াইট হাউজ এই গোয়েন্দা রিপোর্টকে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ আখ্যায়িত করেছে। মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে তাদের হামলা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘পতন’ ঘটিয়েছে। ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ‘বিলুপ্ত’ হয়ে গেছে বলে দাবি করলেও তার প্রশাসন তেমন কিছু বলেনি।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার বলেছেন, ইরানে হামলা পারমাণবিক বিনাশের হুমকি অপসারণ করেছে আর তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচি পুনরুজ্জীবিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা আমাদের অস্তিত্বের প্রতি আসন্ন দুই হুমকি অপসারণ করতে পেরেছি : পারমাণবিক বিনাশের হুমকি এবং ২০ হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস হওয়ার হুমকি।”
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তার দেশ সাফল্যজনকভাবে যুদ্ধ শেষ করেছে; যাকে তিনি ‘বিশাল বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, পেজেশকিয়ান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বলেছেন যে তেহরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিদ্যমান মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলতে প্রস্তুত আছে।
১৩ জুন ভোরে সবাইকে বিস্মিত করে ইরান ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায় এবং দেশটির শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে। এই হামলা ছিল ১৯৮০ দশকে ইরাকের সাথে হওয়া যুদ্ধের পর থেকে ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ইরানও ইসরাইলের সামরিক স্থাপনা ও শহরগুলোতে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দেয়।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাথে সহযোগিতা স্থগিত ইরানের
আলজাজিরা জানায়, জাতিসঙ্ঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাথে সহযোগিতা স্থগিত করার একটি পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। দেশটির সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম নূর নিউজ এ খবর জানিয়েছে।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী এখন থেকে ইরানে ঢুকতে চাইলে আইএইএকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে এবং তাদের পরিদর্শকদের দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সুস্পষ্ট অনুমোদন নিতে হবে।
একজন এমপিকে উদ্ধৃত করে নূর নিউজ বলেছে, এই নতুন নিয়মে কেবল নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলেই আইএইএ পরিদর্শকদের প্রবেশ অনুমতি দেয়া হবে। ইরানি বার্তা সংস্থা মেহর নিউজ জানিয়েছে, আইএইএর সাথে সহযোগিতা স্থগিত করার এই প্রস্তাবের পক্ষে পার্লামেন্টের মোট ২২১ জন সদস্য ভোট দিয়েছেন আর বিপক্ষে কেউ ভোট দেননি, শুধু একজন ভোট দানে বিরত ছিলেন।
প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে পাস হলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। পার্লামেন্টের এ সুপারিশ অনুমোদিত হলে এই নিরাপত্তা কাউন্সিলই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেবে। ইরানের পার্লামেন্ট যথেচ্ছ ড্রোন ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি আইনি প্রস্তাবও পর্যালোচনা করা শুরু করেছে।
সবাইকে বিস্মিত করে ১৩ জুন ভোরে তেহরানসহ ইরানের কয়েকটি শহরে ব্যাপক হামলা চালায় ইসরাইল। তারা দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীকেও হত্যা করে। এ হামলায় প্রচুর ড্রোন ব্যবহার করে ইসরাইলি বাহিনী, যেগুলো তাদের গোয়েন্দারা গোপনে আগেই ইরানে নিয়ে গিয়েছিল বলে খবর গণমাধ্যমের।
কুদস ফোর্সের কমান্ডার কানি জীবিত
টাইমস অব ইসরাইল জানায়, ইরানের চৌকস ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের এলিট শাখা কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল ইসমাইল কানিকে মঙ্গলবার সাধারণ মানুষের সাথে হাসতে ও কথা বলতে দেখা গেছে। দখলদার ইসরাইলের সাথে ইরানের যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, ইসরাইলের হামলায় জেনারেল ইসমাইল কানি নিহত হয়েছেন। কিন্তু এখন দেখা গেছে তিনি জীবিত আছেন এবং মঙ্গলবার ইরানে সরকারপন্থী সমাবেশে যোগ দেন তিনি। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, নিউইয়র্ক টাইমস জেনারেল ইসমাইল কানি নিহত হওয়ার তথ্য জানালেও ইসরাইলি সেনাবাহিনী এ ধরনের কোনো দাবি করেনি। বিপ্লবী গার্ডের কুদস ফোর্স মূলত ইরানের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও হাউছি বিদ্রোহীদের তারা সহায়তা করে থাকে।
এর আগেও একবার ইসমাইল কানি নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বোমা হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ সাবেক প্রধান হাসিম সাইফুদ্দিনকে হত্যা করে ইসরাইল। ওই সময় বলা হয়েছিল, কুদস ফোর্সের প্রধানও সাইফুদ্দিনের সাথে ছিলেন।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল : রাশিয়া
আরটি জানায়, হামলার অজুহাত বানাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল অপতথ্য ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছে রাশিয়া। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া এই অভিযোগ করেন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল মঙ্গলবার রুশ দূত ভাসিলি বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ। আর এসব হামলা তেজস্ক্রিয় দূষণের ‘বাস্তবিক ঝুঁকি তৈরি’ করেছে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পর্যবেক্ষণের পর আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন রুশ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, তারা জোর দিয়ে বলতে চান, আইএইএর প্রতিবেদনে এমন কিছু বলা হয়নি যে, ইরান তাদের পারমাণবিক মজুদ সামরিক বা গোপন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।