- আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমলেও দেশে বেড়েছে
- ঘোষণা ছাড়াই সয়াবিন তেলের দাম বাড়াল কোম্পানিগুলো
দেশের ভোজ্যতেল বাজার আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম টানা তিন মাস ধরে কমতে থাকলেও এর কোনো সুফল ভোক্তাপর্যায়ে দেখা যাচ্ছে না। খুচরা বাজারে লিটারপ্রতি দাম এখন ১৯৮ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। যদিও পাইকারি বাজারে প্রতি মণে দাম কমেছে ৩০০ টাকার বেশি। এ দিকে কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো, যা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তহীনতা এবং শিল্প গোষ্ঠীর একচেটিয়া ক্ষমতা নিয়ে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে পামঅয়েলের দাম আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় কমেছে। আগস্টে প্রতি টনের দাম ছিল ১০১৬ ডলার। নভেম্বরে প্রতি টনের দাম ছিল ৯৫০ ডলার। এ দাম সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন বলে তথ্যে দেখা গেছে।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বাজার প্রতিবেদনে দেখা যায় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দাম অন্তত ৭ থেকে ৮ শতাংশ কমেছে। মালয়েশিয়ান পামঅয়েল বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পামঅয়েলের উৎপাদন বেড়েছে ১১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং মজুদ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এতে বাজারে সরবরাহ চাপ বাড়িয়েছে। মৌসুমি চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশেষত চীনে আগাম শীতের কারণে ব্যবহার কমেছে, ফলে দাম আরো কমতে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ দেশের সবচেয়ে বড় আমদানিকৃত ভোজ্যতেল পাইকারি বাজার। এখানে প্রতি মণ পামঅয়েলের দাম গত সেপ্টেম্বরের ৬,১০০ টাকা থেকে নেমে বর্তমানে ৫,৭৭০ টাকায় এসেছে। অথচ খুচরা বাজারে লিটারপ্রতি দাম ১৫০ টাকা এর কম কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বরং টিসিবির তথ্য অনুযায়ী খোলা পামঅয়েল কিছু জায়গায় ১৫৮ থেকে ১৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরা বাজারে তা না কমার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন সরকারি মূল্য সমন্বয় সভা দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারিত মূল্য কমাতে সাহস পাচ্ছেন না, কারণ অনুমতি ছাড়া দাম পরিবর্তন করলে অভিযানের মুখে পড়তে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছর ভোজ্যতেলের মাসিক মূল্য-সমন্বয় ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববাজারে ওঠানামার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তাদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে গত তিন মাসে কোনো মূল্য-সমন্বয় বৈঠক হয়নি। ফলে আগের নির্ধারিত দামই খুচরা বাজারে চলছে।
বাংলাদেশ হোলসেল এডিবল অয়েল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: গোলাম মাওলা বলেন, বিশ্ববাজারের দাম কমার সুফল ভোক্তাপর্যায়ে যেতেই পারে না, কারণ সরকারের মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা এখন প্রায় বন্ধ। ব্যবসায়ীরাও একা একা দাম কমানোর ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তিনি আরো বলেন সরকারি সংস্থাগুলোর মন্থরতা ও শিল্পগোষ্ঠীর লবিং বাজারকে ‘অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত’ অবস্থায় রেখে দিয়েছে।
দেশের বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন শীত মৌসুমে বিশ্ববাজারে চাহিদা আরো কমবে, কারণ শীতে অনেক দেশে পামঅয়েল জমাট বেঁধে যায় এবং ব্যবহার কমে। ফলে আগামী এক, দুই মাসে বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের দাম আরো কমতে পারে। কিন্তু এ মূল্যপতনের সুফল বাংলাদেশী ভোক্তারা পাবেন কি না, তা নির্ভর করছে সরকারি মূল্য-সমন্বয় ব্যবস্থার ওপর।
এ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারের যুক্তি দেখিয়ে বিপরীত ব্যবস্থা নিয়েছে সয়াবিন তেলের উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে বাজারে। ফলে এখন এক লিটারের বোতল ১৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যেখানে আগের দাম ছিল ১৮৯ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯৬৫ টাকায়।
রাজধানীর কাওরান বাজার, রামপুরা ও মিরপুরে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন কোম্পানিগুলো নতুন মূল্যহারে চালান দিচ্ছে। তবে কোম্পানিগুলো বলছে, বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে, তাই বাধ্য হয়ে তাদের দাম বাড়াতে হয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১১ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন আদেশ অনুযায়ী আমরা সরকারকে ১৫ দিন আগে জানালেই দাম বাড়াতে পারি।
এ দিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন বলেন, দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে কেউ জানাননি। তারা একত্র হয়ে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি করেছে এটি কোনোভাবেই আইনসম্মত নয়। সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি আরো জানান টিসিবির জন্য সরকার যে তেল কিনেছে, সেটি বাজারদরের তুলনায় লিটারে প্রায় ২০ টাকা কম পেয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাজারে হঠাৎ করে দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ দিকে বাণিজ্য সচিবও সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসায়ীদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। অনুমতি ছাড়া তারা কিভাবে দাম বাড়িয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এ দিকে ভোজ্যতেলের অন্যতম প্রধান ভোক্তাচাপের মৌসুম রমজান সামনে রেখে বাজারে নতুন উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। সাধারণত বছরে ফেব্রুয়ারি থেকে তেলের আমদানি, সরবরাহ ও মজুদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এখন পামঅয়েলের দাম কমলেও আমদানিকারকরা দাম কমাচ্ছেন না। সয়াবিন তেলের দাম ঘোষণা ছাড়া বাড়ানো হয়েছে, মূল্য সমন্বয় বৈঠক হচ্ছে না সরকারের বাজার তদারকি দুর্বল। এসব মিলিয়ে রমজানের আগে তেলের দাম আরো বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো: নাজিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান বুকিং দরে পামঅয়েল আমদানি হলে লিটারপ্রতি অন্তত ১০ থেকে ১২ টাকা কম দামে বিক্রি সম্ভব। কিন্তু মূল্য কমাতে হলে সরকারকে অনুমোদন দিতে হবে। বাজার এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে, ঘোষণা ছাড়াই সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো স্পষ্টতই অন্যায় এবং এটি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সমন্বিত বাজার নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্ত। ক্যাবের দাবি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে জরুরি তদন্তে নামতে হবে। বাজারে অভিযান বাড়াতে হবে। প্রকৃত আমদানি মূল্য ও খরচ বিশ্লেষণ করে নতুন মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারের দাম কমলে ভোক্তা কোনো লাভ পায় না, কিন্তু বাড়লে সাথে সাথে ভোক্তাপর্যায়ে বাড়তি চাপ পড়ে এটি অস্বাভাবিক বাজার কাঠামোরই প্রমাণ।
বিশ্লেষকদের মতে, পামঅয়েলের আন্তর্জাতিক মূল্যপতন বাংলাদেশে স্বস্তি আনতে পারত। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং ব্যবসায়ী কারসাজির কারণে বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বরং সয়াবিন তেলের অঘোষিত মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
তারা বলছেন, অবিলম্বে মাসিক মূল্য সমন্বয় বৈঠক পুনরায় চালু করা দরকার। এ ছাড়া বিশ্ববাজারের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন মূল্য নির্ধারণ, অনুমতি ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, রমজানের আগে আমদানির পরিকল্পনা এবং মজুদ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এসব পদক্ষেপ এখনই না নিলে ভোজ্যতেলের বাজারে আবারো বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যার চাপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ ভোক্তারা এমনটাই মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।



