ঢেলে সাজানো হচ্ছে কারা প্রশাসন নজরদারিতে ভিআইপি বন্দীরা

নতুন পদ সৃষ্টি ১,৮৯৯ ২ অতিরিক্ত আইজি, ৬ ডিআইজি, ১৩ অতিরিক্ত ডিআইজি

মনির হোসেন
Printed Edition

বন্দী ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনের তুলনায় জনবল সঙ্কট, অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে কারা প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন আনতে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার পাঁচ ধাপে কারা অধিদফতরে মোট এক হাজার আট শ’ ৯৯টি নতুন পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে কারা অধিদফতর সূত্র নিশ্চিত করেছে। শুধু তাই নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতে রদবদলের অংশ হিসেবে নতুন করে দু’জন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক, ছয়জন ডিআইজি এবং ১৩ জন অতিরিক্ত ডিআইজির পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

কারা অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিদ্যমান ৬৮টি কারাগারে জনবল সঙ্কট ছিল প্রকট। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে নতুন করে একটি বিশেষ কারাগার চালু হওয়ায় এখন কারাগারের মোট সংখ্যা ৬৯টি। কিন্তু এসব কারাগারে নিরাপত্তা, প্রশাসন, চিকিৎসা ও বন্দী ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল বরাদ্দ ছিল না। ফলে বহুদিন ধরেই আধুনিক ও মানবিক কারা ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল বলে তারা মনে করছেন।

নতুন জনবল কাঠামো অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ২০২৮-২৯ পর্যন্ত ধাপে ধাপে কারা প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া হবে। এতে করে বিভিন্ন ক্যাডার পদ যেমন সহকারী সুপার, উপপরিদর্শক, কারারক্ষী, মনোবিজ্ঞানী, নার্স, চিকিৎসক, ড্রাইভারসহ প্রায় সব স্তবে জনবল বাড়ানো হবে। শুধু প্রিজন স্টাফ নয়, বন্দীদের মানসিক পুনর্বাসন ও পরামর্শ সেবার জন্যও নতুন পদ যুক্ত করা হচ্ছে।

কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো: মোতাহের হোসেন এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘কারা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সুশৃঙ্খল করতে হলে জনবল বাড়ানো জরুরি ছিল। আমরা এখন বড় এক রূপান্তরের পথে।’ তিনি আরো বলেন, নতুন নিয়োগের ফলে নিরাপত্তা, বন্দী ব্যবস্থাপনা এবং কারা চিকিৎসাসেবা আরো অনেক উন্নত হবে।

বর্তমানে কারা প্রশাসনে একজন মহাপরিদর্শকের অধীনে সারা দেশে কারাগারগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এবারই প্রথমবারের মতো একজনের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে তিনটি শাখায়। নিরাপত্তা ও অপারেশন, প্রশাসন ও বন্দী ব্যবস্থাপনা। ইতোমধ্যে অতিরিক্ত আইজি প্রিজন হিসেবে কর্নেল তানভীর হোসেন (অপারেশন্স) ও মো: জাহাঙ্গীর কবীর (বন্দী ব্যবস্থাপনা) পদায়ন পেয়েছেন।

কারা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই রদবদল ও পদ বৃদ্ধির সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পড়ে ছিল। ২০২১ সালে প্রথম প্রস্তাব পাঠানো হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা এতদিন অনুমোদন পায়নি। এবার প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।

কেরানীগঞ্জের বিশেষ কারাগারে ভিআইপি বন্দীরা নজরদারিতে

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে সম্প্রতি বিশেষ কারাগারের কার্যক্রম চালু হয়েছে। এই কারাগারে শুধুমাত্র ভিআইপি বন্দীদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে এ কারাগারে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে কঠোর নজরদারির মধ্যে। সূত্র জানিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের গতিবিধি মনিটরিং করা হচ্ছে। শুধু তাদের নয়, তাদের যারা নজরদারিতে রাখছেন তাদের বিষয়েও গোয়েন্দা দিয়ে খোঁজখবর নিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব ভিআইপি আসামিদের সাথে যোগাযোগ সীমিত, বাইরে থেকে কারো প্রবেশাধিকার নেই। এখানে প্রত্যেক বন্দীর জন্য আলাদা নজরদারি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এমনকি প্রতিদিন বদলানো হচ্ছে সেবক, যারা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কারাগার থেকে স্থানাস্থরিত করা হচ্ছে।

কারা সূত্র বলছে, ভিআইপি বন্দীরা যাতে তাদের প্রভাব খাটিয়ে কারাগারের ভেতর কোনো বিশেষ সুবিধা না নিতে পারেন তা নিশ্চিত করতেই এমন কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। এই সময়ে এই কারাগারটি এখন নজরদারির দিক থেকে দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার।

গত রাতে কারা বিশ্লেষক ও সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব:) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘কারা প্রশাসনে এত বড় পদ সৃষ্টি এবং জনবল বাড়ানো অবশ্যই ইতিবাচক দিক। তবে নিয়োগে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে বিপর্যয় নেমে আসবে। দুর্নীতিমুক্তভাবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে না পারলে এর সুফল পাওয়া কঠিন।’

তিনি আরো বলেন, ‘কারা ব্যবস্থা যেন কেবল বন্দীদের আটকে রাখার জায়গা না হয়ে ওঠে। বরং পুনর্বাসন ও সংশোধনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’

গত রাতে কারা অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের বর্তমান আইজি প্রিজন স্যার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কারাগারগুলোতে ফিরতে শুরু করেছে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা। তিনি যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে খুবই কঠোর অবস্থানে থাকেন। পাশাপাশি যারা ভালো কাজ করছেন তাদের তিনি নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন। কোন কারাগারে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে তা তিনি সরেজমিন খোঁজ নিয়ে তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।