সংস্কার নিয়ে আশার আলো

আগামী ২-৩ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে কমিশন

প্রতিটি কমিশন থেকে ১৫ থেকে ৩০টি করে সুপারিশকে ‘শর্ট টার্ম ইমপ্লিমেন্টেবল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেগুলো বাস্তবায়নে কোনো সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন নেই।

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
রাজধানীতে ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক
রাজধানীতে ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক |নয়া দিগন্ত

দেশে রাজনৈতিক ও শাসন কাঠামোর সংস্কার নিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত প্রক্রিয়ায় আশার সঞ্চার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বর্তমানে একটি নতুন বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী দুই-তিন দিন এই সংস্কার উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

দুই ধাপে সরকারের তৎপরতা : ছয়টি কমিশন থেকে গৃহীত প্রতিবেদনগুলো জমা দেয়ার পর সরকার দু’টি প্রধান ধাপে কাজ শুরু করে। প্রথমত, তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশসমূহ চিহ্নিত করে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি কমিশন থেকে ১৫ থেকে ৩০টি করে সুপারিশকে ‘শর্ট টার্ম ইমপ্লিমেন্টেবল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেগুলো বাস্তবায়নে কোনো সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন নেই। এসব সুপারিশ এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কার্যকর করতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সরকারি ফাইল প্রসেসিং টাইমলাইন নির্ধারণ এবং স্থানীয় সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা বাড়াতে নতুন এসওপি চালুর মতো কাজ শুরু হয়ে গেছে।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’, যার দায়িত্ব ছিল ছয়টি কমিশনের সুপারিশের ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা। প্রায় এক হাজার ৬০০ সুপারিশ থেকে নির্বাচন করে ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে একটি ‘ব্রডশিট’ তৈরি করে তা দেশের ৩৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর সাড়া ও বিশ্লেষণ : প্রেরিত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ৩৪টি দল তাদের লিখিত মতামত সরকারকে প্রদান করেছে। এই মতামতগুলো বিশ্লেষণ করে সরকার এমন একটি পরিসংখ্যান পেয়েছে যেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ সুপারিশে শতভাগ রাজনৈতিক দল একমত। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু সুপারিশে ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত ঐকমত্য রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলছে, যেখানে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে মতপার্থক্যপূর্ণ সুপারিশকে কেন্দ্র করে সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একাধিক রাউন্ডের আলোচনা হচ্ছে। প্রধানত এগুলো সংবিধান সংশোধন, সংসদ কাঠামো, নির্বাচন ব্যবস্থা ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত বিষয়।

বিতর্কিত তিনটি ইস্যু : বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দু বিতর্কিত তিনটি ইস্যু। যদিও বেশির ভাগ সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত, তবুও তিনটি সুপারিশে গভীর মতানৈক্য রয়ে গেছে। এগুলো হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হবে কিনা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা, আর সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করার বিষয়টি।

এই তিনটি বিষয় রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এবং দলগুলোর আদর্শগত অবস্থান এতে ভিন্ন। তবুও কমিশনের আশা, চলমান আলোচনার মাধ্যমে কমপক্ষে একটি সর্বসম্মত বা আপসমূলক ফর্মুলা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

আইনি ভিত্তি : গণভোট না সংবিধান সংশোধন : এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ও জাতীয় ঐকমত্যের প্রেক্ষাপটে এখন মূল প্রশ্ন হলো- এই ঐকমত্যের আইনি ভিত্তি কী হবে? এ বিষয়ে তিনটি প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেয়া, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে স্থায়ী রূপ দেয়া এবং একটি গণপরিষদ গঠন করে পরবর্তী সরকারের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে সরকার এখন শেষ ধাপের মূল্যায়নে রয়েছে এবং শিগগিরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হবে।

লিখিত প্রতিশ্রুতি ও টেকসই বাস্তবায়নের কাঠামো : আগামী নির্বাচিত সরকার যাতে এই সুপারিশগুলো উপেক্ষা করতে না পারে, সে জন্য সরকার একটি লিখিত জাতীয় প্রতিশ্রুতি (ন্যাশনাল কন্সেন্সাস চার্টার) তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এই সনদে সব রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর থাকবে এবং নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে এটি গ্রহণযোগ্য হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সুপারিশগুলো টেকসই আইনি কাঠামোর অধীনে বাস্তবায়িত হতে পারবে এবং ভবিষ্যৎ সরকার এতে বাধ্য থাকবে।

বাংলাদেশ কি নতুন পথের দিশায় : রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদসহ সব মহলের অংশগ্রহণে এই সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে সফলতা নির্ভর করছে আগামী দুই-তিন দিনের ফলাফলের ওপর। যদি এই সময়ের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি হয়, তবে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই একটি নতুন রাজনীতিক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত সংস্কার অভিযাত্রা শুরু করতে পারবে।