ফজলে মিনহাজ
দেশে সম্প্রতি একটি শব্দ বহুল চর্চিত হচ্ছে, ‘মব’। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি, হেনস্তার পাশাপাশি ব্যক্তিবিরোধেও ‘মব’ তৈরি করে নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসছে। যদিও ‘মব’ শব্দটি এখন বেশি আলোচিত হচ্ছে, তবে এই শব্দের ব্যবহার না হলেও এ ধরনের ঘটনা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, আদালতের বিচারের রায়কে পাল্টে দেয়ার জন্য চাপ তৈরি করতে কথিত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তৈরি, রাজনৈতিক ‘ট্যাগ’ দিয়ে আবরার ফাহাদসহ অনেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা, পুলিশে ধরিয়ে দেয়া বা কারাগারে নিক্ষেপ করা মবোক্রেসিরই কার্যকলাপ।
পতিত আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও তাদের অনুরক্ত মিডিয়ার বয়ানে এখন ক্ষুব্ধ মানুষের অপরাধী বা আসামি ধরাও ‘মব’ বলে প্রচার হচ্ছে। তবে এর বাইরেও যে কিছু বেআইনি ঘটছে না, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটার সুযোগ কেন হচ্ছে তা নিয়ে সামান্য বলতে চাই। ‘মব জাস্টিস’ বা ‘জনতা দ্বারা নিজ হাতে বিচার’ একটি গুরুতর সমস্যা। এমন কাজ যেমনি অপ্রত্যাশিত তেমনি অগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্রের আইন যখন সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে তখনই এমনটা ঘটার সুযোগ তৈরি হয়। এক কথায় রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ দুর্বল হলে মব জাস্টিসের ঝুঁকি থাকে। তাই এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও জনবান্ধব করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে অপরাধী ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রাপ্য শাস্তি পায় এবং জনতা দ্বারাও যেন আইনবহির্ভূত কাজের সুযোগ না হয়। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা বা বিচারবহির্ভূত হত্যা জাতির জন্য কখনো সুখকর নয়, স্বস্তির নয়। ‘মব’ নিয়ে আলোচনা এখানে ইতি টানলাম।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৭ বছর জিম্মি থাকা গণতন্ত্র দিশা পায় গত বছরের আগস্টে। সেসময় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটে। ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ দম্ভোক্তি করেও শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়। তিন দিন সরকারবিহীন থাকার পর দেশে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তারা দায়িত্ব নিয়েই নানান সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তারা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আর প্রতিটা দাবি আদায়ের আন্দোলনকে তীব্র করার কূট-কৌশলের ছক আঁকতে পতিত স্বৈরাচার ও সুযোগসন্ধানী দেশবিরোধী একটি মহল।
মনে রাখতে হবে, চব্বিশ আমাদের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। হাজারো মানুষ বিভিন্ন বানোয়াট মামলায় কারান্তরীণ ছিলেন, শত মায়ের সন্তান রাতে শান্তিতে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারেননি। তারা ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্টে দেশবাসীর ওপর সৃষ্টিকর্তার নেমে আসা রহমতের সুবাদে ঘরে ফিরেছেন।
দেশে এখন মুক্ত হাওয়া। তাই সবাই এখন কথা বলতে পারছে। এমনকি আওয়ামী লীগের হার্ডকোর, সফটকোর বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানেরও সমালোচনা করার সাহস পাচ্ছে।
যদিও ঠিক এই চর্চাটাই গত ১৭ বছর বন্ধ ছিল। শুধু পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসররা যা বলেছে তা জনগণকে গিলতে হয়েছে। তাই হঠাৎ তৈরি হওয়া উন্মুক্ত পরিবেশে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিতর্ক ও অবস্থানগত বিরোধে জনমনে নানান শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই শঙ্কা যেন বিপদে রূপ না নেয়, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধ বা বিতর্ক যেন ফ্যাসিবাদের বয়ান তৈরিকারী দোসর ও তাদের অন্ধভক্তদের সুযোগ তৈরি করে না দেয়। যেকোনো অপরাধের বিচারের জন্য আইন-আদালত আছে, সুস্থ বুদ্ধির নাগরিকদের এর ওপরই আস্থা রাখতে হবে। কেউ যেন কথিত ‘মব’ করতে না পারে, সেজন্য জুলাই বিপ্লবীদেরই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, রাখতে হবে আইনের সহায়তাকারীর ভূমিকাও।
যদিও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় একটি পক্ষ বিপ্লবী ছাত্র-জনতার মাঝে বিভক্তি তৈরির হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের গণ-ঐক্যকে বিনষ্ট করার অপ-রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। যা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সম্ভাবনাকে হোঁচট খাওয়াতে পারে।
আশার কথা হলো, এত শঙ্কার মধ্যেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের সাথে বসে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার নিরলস সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তিনি তার সরকারের কার্যক্রম নিয়েও আশ্বস্ত করছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে। কিন্তু তারা বুঝেও আবার কেন যেন অবুঝ! রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনি যত জায়গায় হাত দিয়েছেন সর্বত্র প্রতিবন্ধকতা। সচিবালয়, এনবিআরে ব্যাপক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। যে যার যার বিভাগে কর্মবিরতি দিয়ে রেখেছে। অন্য দিকে মেয়রের ক্ষমতা পেতে একজন নগর ভবনে তালাও দেয়ারও সাহস করে ফেলেছেন। এতসব অচলায়তনে প্রফেসর ইউনূস এক প্রকার মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কি না সে প্রশ্নও জাগছে।
একদিকে সরকার তার স্বাভাবিক কাজে হোঁচট খাচ্ছে, অন্য দিকে জুলাইযোদ্ধারা নানানভাবে বিভক্ত। ফলে আজ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বড়দল নির্বাচনের জন্য মরিয়া। কিন্তু এত কিছুর পরও অন্তর্বর্তী সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কারের চূড়ান্ত সময় অতিবাহিত করছে। যা জনমনে একপ্রকার আশার আলো দেখাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রাষ্ট্র সংস্কার আলোচনায় নানান মত উঠে আসছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ মনে করে, এখন নির্বাচনী রোডম্যাপের আগে একটি জাতীয় রাজনীতির রোডম্যাপ জরুরি। যার মাঝে মতের ভিন্নতা থাকবে, আদর্শিক ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু আগামীর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটা জাতীয় ঐকমত্য জাতির সামনে দলিল হয়ে আসবে। সেই সাথে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও পরাজিত ফ্যাসিবাদের বিষয়ে কোন দলের কী ভূমিকা থাকবে তা জাতির কাছে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। একই সাথে সেই রোডম্যাপে লিপিবদ্ধ থাকবে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান শুধু ‘জনগণের জন্য উৎসর্গীকৃত’। কোনো দল নিজেদের একক কৃতিত্ব নিতে পারবে না। কার দলে কতজন শহীদ তা গণনা করে জাতির সামনে তামাশা করতে পারবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে এবার ১০ মাসের দেশ পরিচালনার হিসাব নিকাশ কষে সাধারণ জনগণের মনের আশা-আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করে তাদের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসা। শুধু নির্বাচন নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের সিন্ডিকেট জনগণের প্রতিনিধি ভাবলে তা রাজনীতি না বোঝা সাধারণ মানুষের সাথে একপ্রকার জুলুমবাজি হবে।
ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে এই সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। তাই এই রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে গ্রামের খেটে খাওয়া আপামর জনসাধারণের মনের ভাষা বুঝতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সাথে বসতে হবে। শুধু কিছু রাজনৈতিক দলের পরামর্শ শুনতে গিয়ে সাধারণ জনগণের কথা ভুলে গেলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য আরেকটি অমানিশা হাতছানি দেবে।