এ এক ভয়ানক ফাঁদ। লোহার রিংয়ের সাথে মিহি সুতো দিয়ে ঘন ঘন গিটে তৈরি মাছ শিকারের ম্যাজিক। যার রয়েছে একাধিক নাম। দেশের বিভিন্ন জেলায় জেলেদের কাছে এর চাহিদা ব্যাপক। এটিকে কেউ বলে চায়না জাল, কেউবা বলেন, ম্যাজিক বা ঢলুক জাল। পানির নিচে অর্ধশত মিটার দৈর্ঘ্যরে এই জাল পাতা থাকায় তা সহজে বোঝা যায় না। যাতে একবার মাছ ঢুকলে আর বের হতে পারে না। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো- এটি মাছ শিকারের জন্য হলেও তাতে আটকা পড়ে মারা যায় শামুক-ঝিনুক, ব্যাঙ, কাঁকড়া, সাপ, মাছরাঙা পাখি, কুচিয়াসহ বহু জলজ প্রাণী। ফলে মিঠা পানির মাছসহ ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য।
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের মতো মিহি ও হালকা এই জাল একবারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মাছ ধরতে সক্ষম, যা মাছসহ জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর। কিন্তু মাছ শিকারের জন্য দেশে নতুন এ জালের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। যদিও কারেন্ট জালের মতো এই চায়না দুয়ারিও নিষিদ্ধ।
তাদের ভাষ্য, চার কোনা রড দিয়ে অনেকগুলো ফ্রেম বানানো জালে প্রয়োজন অনুসারে দৈর্ঘ্য অনুযায়ী রডের ফ্রেমের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এটি নদীর একেবারে তলদেশ পর্যন্ত যায় এবং তলদেশের মাটির সাথে মিশে থাকে। ফলে কোনো মাছ একবার জালে ঢুকলে আর বের হতে পারে না।
মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, চায়না দুয়ারি জালের কারণে নদীতে মাছের বিচরণ কঠিন হয়ে গেছে। আর সে ক্ষেত্রে কারেন্ট জালের চেয়েও বিপজ্জনক চায়না দুয়ারি। তার ভাষ্য, দু’টি জালই হালকা ও মিহি বুননের হলেও চায়না দুয়ারি ছোট ফাঁসবিশিষ্ট, যা কপাটের মতো কাজ করে।
এতে মাছসহ যেকোনো জলজ প্রাণী একবার ঢুকে পড়লে জালের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে কম পরিশ্রমে বেশি মাছ শিকার করা সহজ।
এ জাল জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূলত সমস্যাটি হলো এতে মাছ, মাছের বাচ্চা বা পোনা এবং এমনকি মাছের ডিমও উঠে আসে। এতে অনেক বিপন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী মারা পড়ে। সেগুলো আর ওই সব প্রাণীর বংশবৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। ফলে পানিতে থাকা জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চায়না দুয়ারি জাল নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। বেলা বলছে, অতি সূক্ষ্ম ফাঁসের এ জালে আটকে জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এ জালে প্রতিনিয়ত সাপ, ব্যাঙ, পোনা মাছসহ নানা ধরনের জলজ প্রাণী ও কীটপতঙ্গ আটকে যাচ্ছে এবং জাল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে শরীর ছিঁড়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ঘটছে। এ ছাড়া খাদ্যের জন্য মাছের ওপর নির্ভরশীল দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি বিশেষ করে মাছরাঙা ও বক আটকে যাচ্ছে এসব জালে। ফলে জলজ জীববৈচিত্র্যের খাদ্যশৃঙ্খল ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র।
বেলা জানায়, দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সাড়ে চার সেন্টিমিটারের চেয়ে ছোট ফাঁসবিশিষ্ট জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অবস্থায় জলাধারগুলোতে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি তা ব্যবহারের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা উচিত।