সাক্ষাৎকার

রাজনৈতিক বিভক্তি সামাল দিতে না পারলে পরিণতি অমঙ্গলজনক

বদিউল আলম মজুমদার

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
বদিউল আলম মজুমদার
বদিউল আলম মজুমদার

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিকদলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে সরকারকেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, কলহপ্রবণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিভক্তির রাজনীতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে এর পরিণতিতে শুধু রাজনীতিবিদকেই নয় একই সাথে জাতিকেও ভুগতে হবে।

তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া চূড়ান্ত। রাজনৈতিক দলগুলো এ সনদে স্বাক্ষর করতে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করেছে প্রায় তিন সপ্তাহ। সনদ বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তা নির্ধারণের জন্যই তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছে। আজ রোববার তারা ফের বসছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে। জুলাই সনদ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তি এখন মূল কাজ। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে তা হবে সব চেয়ে ভালো। দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে আমাদের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দিয়ে আমাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করব।

নয়া দিগন্ত : জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কি সরকার কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে? রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিষয়টি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারে তা হলে সরকারকেই তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাই না?

বদিউল আলম মজুমদার : সরকার অবশ্যই ডিটারমাইনড হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আগাতে পারে। কিন্তু সব দিক থেকে চাপ থাকবে। সরকার হয়তো নেবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারে তা হলে বলটা সরকারের কোর্টেই যাবে। তাদেরকেই সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নয়া দিগন্ত : রাজনৈতিক বিভক্তি বাড়ছে এবং নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তো শেষ পর্যন্ত এই বিভক্তি সামাল দেয়া কি সম্ভব হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : আশা করি সামাল দেয়া সম্ভব হবে এবং হওয়া দরকার। তা না হলে তার পরিণতি হবে অমঙ্গলজনক।

নয়া দিগন্ত : অবশ্য অতীতেও এ ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটকে আমরা অতিক্রম করেছি।

বদিউল আলম মজুমদার : এত বড় ক্রাইসিস বোধ হয় আমরা আমাদের ইতিহাসে এইরকম মুখোমুখি হই নাই। কারণ এই ক্রাইসিসটা হয়েছে এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে। অনেক ব্যক্তি অকল্পনীয় আত্মত্যাগ করেছে, অনেকে আহত হয়েছে। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। এখন যে সম্ভাবনাটা সৃষ্টি হয়েছে তা যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি তা হবে দুঃখজনক এবং কাজে না লাগাতে পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের কলহপ্রবণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, বিভক্তির রাজনীতি। এখন এই পরিস্থিতি যদি আমরা কাটিয়ে না উঠতে পারি তা হলে এর পরিণতিতে শুধু রাজনীতিবিদকেই নয় একই সাথে জাতিকেও ভুগতে হবে।

নয়া দিগন্ত : ফ্যাসিস্ট শক্তি তো ফিরে আসার চেষ্টা করছে।

বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ, তারা তো ফিরে আসার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা তো সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। তাদের হাতে অর্থ আছে, তাদের হাতে বিভিন্ন রকমের সহযোগিতা আছে, বিদেশী স্বার্থে অনেকেই চেষ্টা করছে কিন্তু তারা যেটা ভুলে গিয়েছে তারা যে অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে তা অমার্জনীয়। তার জন্য তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। ক্ষমাও চায়নি। এ জন্য তাদের ফিরে আসাটা আমি মনে করি না এত সহজ হবে। কিন্তু এটা একমাত্র সহজ করে দিতে পারে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিভক্তি এবং কারো কারোর তাদেরকে পুনর্বাসনে চেষ্টা করা। আমি আশা করি না যে এ ধরনের আত্মঘাতী কাজ আমরা করব।

নয়া দিগন্ত : জুলাই আন্দোলনের আগেও তো ধারাবাহিকভাবে আপনারা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও টেকসইমূলক গণতন্ত্র বা কার্যকর সংসদের কথা বলে আসছেন, তো এখনো এত রাজনৈতিক বিভক্তি অবশিষ্ট থাকে কিভাবে?

বদিউল আলম মজুমদার : বাংলাদেশকে পেয়েছি আমরা অনেক আত্মত্যাগে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। যে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বরং আমাদের এ থেকে বিচ্যুতি ঘটে গেছে।

নয়া দিগন্ত : এ জন্য তো খেসারত কম দিতে হয়নি।

বদিউল আলম মজুমদার : হ্যাঁ জাতিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। চরম খেসারত তো জুলাই আন্দোলনের এই আত্মত্যাগ। আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত ছিল।

নয়া দিগন্ত : দেশকে নতুন করে গঠন করার সুযোগও তো পাওয়া গেছে।

বদিউল আলম মজুমদার : অবশ্যই, রাষ্ট্র মেরামতের একটা অপূর্ব সুযোগ, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, নির্বাচন নির্বাসনে গিয়েছিল, এখন নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্ত একটা ভিতের ওপর কিভাবে দাঁড় করানো যায়, কিভাবে গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হবে এসব কাজ পড়ে আছে।

নয়া দিগন্ত : বৈষম্য দূর করতে হলে তো ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও কোনো বিকল্প নেই।

বদিউল আলম মজুমদার : এক্সাক্টলি, অনেকগুলো বিষয় আমরা যেগুলো করতে পারি নাই। ব্যর্থ হয়েছি। সেগুলো করার অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগের অংশ হিসেবে আমরা এতগুলো রাজনৈতিক দল মাসের পর মাস, দিনের পর দিন আমরা বসে আলাপ-আলোচনা করেছি কি কি করণীয়। কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে, এগুলো যদি বাস্তবায়িত না হয়, এর ভিত্তিতে যদি একটা সুষ্ঠু একটা নির্বাচন না হয়, আমরা যদি পুরনো সংস্কৃতিতেই ফিরে যাই, তা হলে আমাদের জন্য বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। ইন এ সেন্স এই নির্বাচনকে বলা যায় একটা ফাউন্ডেশন ইলেকশন। একটা নতুন ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করবে।

নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্র বিনির্মাণের একটা ভিত্তি তৈরি করবে কি এ নির্বাচন?

বদিউল আলম মজুমদার : রাষ্ট্র বিনির্মাণের পাশাপাশি একই সাথে টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে কার্যকর হয় সে জন্য যে সকল পরিবর্তন দরকার যেমন প্রাতিষ্ঠানিক, আইনগত বিধিবিধান পরিবর্তন, কতগুলো মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক পরিবর্তন, কাঠামোগত সংস্কার এগুলো যদি আমরা না করতে পারি তা হলে আমরা হবো দুর্ভাগা জাতি। তার মাশুল শুধু আমরাই দেবো না, আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা দেবে।

নয়া দিগন্ত : ছাত্র-জনতার এত বড় আন্দোলনের পর ছাত্ররা নিজেদের যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার সুযোগ না পেলে দেশ গড়ার রসদ বা মানবসম্পদ কোথায় পাওয়া যাবে?

বদিউল আলম মজুমদার : দেখেন শরীরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন কাজ। হাতের যে কাজ, মাথার একটা কাজ, নাকের একটা কাজ, মুখের একটা কাজ ইত্যাদি। মুখের কাজ নাক দিয়ে করতে গেলে সমস্যা হবে।

নয়া দিগন্ত : মেধা সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে?

নয়া দিগন্ত : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতো মারামারি, দলবাজি, বিভিন্ন রকম নৈরাজ্যমূলক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর থেকে উত্তরণ ঘটানো দরকার। আমাদের দুঃখ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন ঢেলে সাজাতে হবে। সত্যেন বোসের পর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আমাদের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা মেধার দিক থেকে তার চেয়ে কোনো অংশে কি কম? ভারতে আইআইটি যে লোকবল তৈরি করছে তারা বিশ্বমানের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছে, আমরা কেনো পারছি না।

নয়া দিগন্ত : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বরাদ্দ পায়, তা দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর মেধা গড়ে তোলা যায়, শুধুই কি বরাদ্দের অভাব?

বদিউল আলম মজুমদার : না, না, শুধু ফান্ডের অভাব নয়, যার যে কাজ সে তা করছে না। শিক্ষক তার কাজ করছে না, ছাত্ররা তার কাজ করছে না, কর্মকর্তারাও তাদের কাজ করছে না, তারা করছে দলবাজি। বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম। গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষকরা যে বক্তব্য দিয়েছেন কোনো শিক্ষকের পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম, ছাত্র ছিলাম, ছাত্র রাজনীতি করেছি, ৬৯ এর গণআন্দোলনে আমাদের ভূমিকা ছিল, এখনকার অবস্থা তো আমার কল্পনার অতীত। আমাদের শিক্ষকরা ছাত্রদের মধ্যে যে ব্যাপক অবক্ষয় ঢুকিয়ে ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দিয়েছে, ভবিষ্যতের এগিয়ে যাওয়াকে রুদ্ধ করে দিয়েছে, এটি ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।