জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনে সময় সংগঠিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য দুই মাস সময় নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। গতকাল রোববার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আমরা দুই মাস সময় চেয়েছি। যদিও এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে যাবো। আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৪ জুনের মধ্যে শেখ হাসিনার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্য দিকে আগামী এক বা দুই দিনের মধ্যে রাজধানীর চানখাঁরপুলে সংঘটিত গণহত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে যাবো বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগামী এক বা দুই দিনের মধ্যেই দু-একটি মামলার সুখবর অপনারা পাবেন। আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু করার জন্য আমরা এক বা দুই দিনের মধ্যেই আমরা চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পাবো। আমরা পাওয়ার পরই আপনাদের অনুষ্ঠানিকভাবে জানাবো। শেখ হাসিনার মামলার একটু সময় লাগছে। অন্য এক বা একাধিক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন শেষপর্যায়ে আছে। সেগুলো আমরা পেয়ে যাবো বলে আশা করছি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ট্রাইব্যুনালে আজ (রোববার) তিনটি মামলার শুনানি হয়েছে। প্রথম মামলাটিতে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জন আসামি রয়েছেন, যারা এই অপরাধের নির্দেশদাতা ছিলেন। মামলার ১৭ জন আসামি উপস্থিত ছিলেন। আমরা আজ (রোববার) আদালতে এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে একটি রিপোর্ট দিয়েছি। আমরা এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য দুই বা তিন মাসের সময় চেয়েছি। আদালত আগামী ২০ জুলাই এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গুমের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ২৪ জুন : শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দুই মাসের সময় চাওয়া হয়। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৪ জুন এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন।
এ মামলায় মাত্র একজন গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি জিয়াউল আহসান। রোববার তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এ মামলার শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, গুমের প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে। র্যাব-১ ও র্যাব-২-এর কার্যালয় এবং কচুক্ষেতে গুম কেন্দ্রের সন্ধান পেয়েছেন। সেগুলো তিনি পরিদর্শন করেছেন এবং আলামত জব্দ করেছেন। কিছু কিছু আলামত ধ্বংস করারও চেষ্টা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ২০০ গুমের ঘটনার তদন্ত শেষ দিকে রয়েছে। তিনি বলেন, ৮০০ থেকে ৯০০ মানুষ গুম করা হয়েছে। ৩০০ মানুষ গুম করে হত্যা করা হয়েছে। শত শত মানুষ গুমের ঘটনার তদন্ত শেষপর্যায়ে। সেগুলোর আলাদাভাবে রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছি।
হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে আনা নিয়ে বিতর্ক-পুলিশকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ : হ্যান্ডকাফ পরানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ও হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে। গত রোববার শুনানির সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ অভিযোগ করেন পুলিশের দুই সদস্য। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রোববার সাবেক ১২ মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ১৭ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুনানির একপর্যায়ে ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের হাতকড়া পরানোর বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন।
হাতকড়া পরানোর বিষয়ে জানতে চেয়ে আদালত দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ডাকেন। এ সময় এজলাশের দিকে এগিয়ে যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। তারা আদালতকে বলেন, পুলিশ হেডকোর্য়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী গাড়ি থেকে নামানোর সময় হাতকড়া পরানো হয়। প্রিজনভ্যান থেকে নামানোর সময় শাজাহান খান ও হাসানুল ইনুকে পরাতে গেলে ক্ষেপে যান। বেশ উগ্র মেজাজে আমাদের নির্বংশ করার হুমকি দেন তিনি। এমনকি রাজাকারের বাচ্চা বলেও গালি দেয়া হয়। শাজাহান খান বলেছেন, তোদের নাম নোট করে রাখলাম। রাজাকারের বাচ্চারা। তোদের চৌদ্দগুষ্ঠি দেখে নেব। তাদের আচরণ হিংস্র ছিল।
শুরুতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান আদালতে আসামিদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান কে তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এনেছে। আদালত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ করে বলেন, আদালতে কেন তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আনা হয়েছে। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য বলেন, আমরা তাদের বিনয়ের সাথে বলেছি। কিন্তু আমাদের সাথে ইসরাইলি বাহিনীর মতো উগ্র আচরণ করা হয়েছে। আমাদের হেনস্তা করা হয়েছে। চৌদ্দগুষ্টিসহ দেখে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। একজন হেলমেট ছুড়ে ফেলেছে।
ট্রাইব্যুনালে শুনানির একপর্যায়ে শাজাহান খান বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যে কথাগুলো হয়েছে, তা সত্য নয়। গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় গাড়ির মধ্যে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অন্য যারা আছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা আমাদের মর্যাদা পেতে চাই।
এ সময় সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের সাথে কোনো কথা হয়নি।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, আপনারা মন্ত্রী ছিলেন। নেতা ছিলেন। আপনারা নিয়ম ভঙ্গ করলে পুলিশ আইন ও জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে। আমরা বলে দিচ্ছি, আদালতে হ্যান্ডকাফ না লাগাতে।
অন্য দিকে সাকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মামলার অভিযোগের কপি ও ট্রাইব্যুনালের সংশোধিত আইন না পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্ট আকর্ষণ করে বলেন, আমরা পড়ালেখা জানা লোক। এগুলো পাওয়ার ও দেখার আমাদের অধিকার রয়েছে। এ সময় চিপ প্রসিকিউটর বলেন, আপনাদের আইনজীবীদের কপি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আইন অনুযায়ী আসামিরা মামলাসংক্রান্ত যেসব নথি পাবেন তা দেয়ার ব্যাপারে আশ^াস্ত করেন।
এ বিষয়ে চিপ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আদালতে আসামিকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তোলা হবে কি না, সেটা জেল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আসামিকে যদি কন্ট্রোল করতে না পারা যায় এবং তার পক্ষ থেকে যদি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে তাহলে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বা আরো জটিল কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করে আদালতে তুলতে পারে জেল কর্তৃপক্ষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর সদস্যরা আদালতকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান ও জিয়াউল হাসান তাদের নির্বংশ করার হুমকি দিয়েছেন। তাদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছেন। এ ছাড়া এদের মধ্যে একজন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হেলমেটও ছুড়ে মেরেছেন। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করে তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়েছে।
এ দিকে রোববার সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টাসহ ১৯ আসামিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনালে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।



