বল, তুই জামাতের? তুই শিবিরের? কেন গার্লফ্রেন্ড নাই? মুখে বড় দাড়ি কেন? টাকনোর ওপর কেন প্যান্ট পরিস? তুই কেন ফজরের নামাজ জামাতে পড়স? এসব অসংখ্য উদ্ভট প্রশ্ন জানতে চেয়ে নির্যাতনের শিকার হন জামায়াতে ইসলামী-শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত থাকা এক ভুক্তভোগী। তারপরই তাকে চিৎ করে শুইয়ে দুই হাতের মধ্যে আর দুই পায়ের মধ্যে বাঁশ দিয়ে এর উপরে চারজন উঠে বসে। এরপর মুখের উপরে একটা কাপড় দিয়ে উপর থেকে পানি ঢালতে থাকে। তখন তার মনে হচ্ছিল যেকোনো সেকেন্ডের মধ্যে মারা যাবে। কেন তিনি রোহিঙ্গাদের সাহায্য করেছেন সে জন্যও সহ্য করতে হয় ভয়ানক নির্যাতন ।
এছাড়াও বিএনপির সাথে জড়িত এক ভুক্তভোগীকে ডিজিএফআইয়ের জেআইসিতে আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতনসহ করতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন- আপনি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য কী করতেন? উনার সেফটি সিকিউরিটিতে কোন কোন দেশ ইনভলভ। কারা তাকে সহযোগিতা করে। আপনি এম্বাসিগুলোতে যেতেন। এম্বাসি থেকে উপহার আসতো। উনি গিফট দিত। এগুলো গিফটে কী ছিল? উত্তর দিতে অস্বীকার করতেই হাতুড়ি দিয়ে তার হাঁটুর মধ্যে আঘাত করে। সে সময় বাঁধা ছিল তার চোখ। পরে আবারও জানতে চায় তারেক রহমানের অ্যাকাউন্ট ডিটেইল বলেন, কোন কোন জায়গায় তার টাকা থাকে। ম্যাডাম জিয়ার টাকা কোথায় দিয়েছেন? কোথায় রাখেন? খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে কোন কোন দেশ থেকে সহযোগিতা করে বা করে কিনা, কারা করে? তখন না বলাতে শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম হওয়া ভুক্তভোগীরা স্বেচ্ছায় তাদের রাজনৈতিক পরিচয় স্বীকার করে এসব ঘটনার বর্ণনা দেন। তবে তারাও জানতো না কেন তাদের ধরে আনা হয়েছে। আর তারা যে গুম হচ্ছে সেটাও বুঝার উপায় ছিল না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের চোখ বেঁধে যানবাহনে করে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পথের মাঝখানে থামিয়ে অন্য দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই ধরনের অনেক ক্ষেত্রে, স্থানান্তরের সময় চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া শারীরিকভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিটি সংস্থা নিজস্ব সরঞ্জাম ব্যবহার করে, যা এই হস্তান্তরের সময় একটি সূক্ষ্ম প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নির্দেশ করে। এই নমুনায় ২৫৩টি মামলার মধ্যে ১৩৮টি অর্থাৎ প্রায় ৫৫ শতাংশ মামলায় একাধিক সংস্থার অংশগ্রহণ জড়িত ছিল। এই মামলাগুলোতে, একটি সংস্থা প্রাথমিকভাবে অপহরণ করে এবং পরবর্তীতে ভুক্তভোগীকে অন্য একটি সংস্থায় স্থানান্তর করে, প্রায়শই তৃতীয় বা এমনকি চতুর্থ সংস্থাকে জড়িত করে ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার আগে। ভুক্তভোগীদেরকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা ছিল একটি দ্বি-ধারী তলোয়ার।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের তথ্য মতে, অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে পরীক্ষাধীন ২৫৩টি অভিযোগের মধ্যে ১০১ জন ব্যক্তির রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নির্ধারণ করা যায়। যা নমুনার প্রায় ৪০ শতাংশ। এই ২৫৩টি মামলা বর্তমানে তাদের কাছে থাকা প্রায় এক হাজার ৮০০টি অভিযোগের একটি নির্দিষ্ট উপসেট। অপহরণকারীদের ২৩৩ জন ব্যক্তির মধ্যে ২২১ জন জানিয়েছেন, যারা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন তারা ইউনিফর্মের পরিবর্তে সাদা পোশাকে ছিলেন। এই অপ্রতিরোধ্য ধরনটি এই অভিযানের গোপন এবং বিচারবহির্ভূত প্রকৃতিকে আরো জোরদার করে, যেখানে সরকারি পরিচয় ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা হয়। সাধারণ পোশাক ব্যবহার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা এড়াতে, ভয় বাড়াতে এবং দায়িত্ব শনাক্ত করার প্রচেষ্টাকে জটিল করার জন্য একটি সুপরিকল্পিত কৌশল।
গুম সংক্রান্ত কমিশন আরো জানায়, ২৫৩টি ঘটনার মধ্যে, ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই মুসলিম, যার মধ্যে মাত্র দু’জন হিন্দু। একইভাবে, প্রায় সব ভুক্তভোগীই ছিল পুরুষ, যার মধ্যে মাত্র দু’জন মহিলা। তবে মুসলিম পুরুষদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু নির্যাতনের শিকারদের লক্ষ্য করা গেছে।