ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের শেয়ার বাজেয়াপ্তের ধীরগতিতে বাড়ছে ঝুঁকি

ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ার ১৬১ কোটি। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩১ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার শেয়ার, যা মোট শেয়ারের ৮১.৫৯ শতাংশ।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে ইসলামী ব্যাংক এক সময় ছিল সবচেয়ে সুশৃঙ্খল, লাভজনক ও আস্থার প্রতীক প্রতিষ্ঠান। প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে ব্যাংকটি ছিল সর্বোচ্চ অবস্থানে। প্রায় চার দশকের পরিশ্রমে ব্যাংকটি আমানতের পরিমাণ দাঁড় করায় প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকায়। সাধারণ জনগণের সঞ্চয় ও রেমিট্যান্স নির্ভর এই ব্যাংক ধীরে ধীরে দেশের ব্যাংকিং খাতের একটি মডেল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় একক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মাফিয়া এস আলম গ্রুপের হাতে। এর পর শুরু হয় ব্যাংকটির ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।

এস আলমের মালিকানা দখল ও শেয়ার নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ার ১৬১ কোটি। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩১ কোটি ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার শেয়ার, যা মোট শেয়ারের ৮১.৫৯ শতাংশ।

বাজারে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪২ টাকা হিসেবে এস আলমের শেয়ারগুলোর বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এস আলমের এই বিপুল মালিকানা অর্জনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীরব অনুমোদনে ব্যাংকটির মালিকানা স্থানান্তর করা হয় এস আলমের কাছে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে এস আলমপন্থী পরিচালক বসানো। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ৩২ জন স্থানীয় পরিচালক এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি বা বিকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। কার্যত ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যায় এস আলম গ্রুপের হাতে।

লুটপাটের কৌশল : অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো নামে-বেনামে লুট করেছে প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট (ওবিইউ) থেকেই তুলেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

এই ঋণগুলোর অধিকাংশই এখন মন্দ ঋণ হিসেবে পরিগণিত। অভিযোগ আছে, ব্যাংকের কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা ও পরিচালকের যোগসাজশে এস আলমের নামে নয়, বরং ভুয়া প্রতিষ্ঠান, আত্মীয়স্বজন এবং সহযোগী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা পালন করেছেন এস আলমের সাবেক পিএস ও পরে ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও কোম্পানি সেক্রেটারি জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ। তাদের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রস্তাব তোলা হতো এবং পরিচালকরা কোনো আপত্তি ছাড়াই তা অনুমোদন করতেন। অনেক কর্মকর্তাকে চাকরি হারানোর ভয়, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখিয়ে এসব ফাইলে করতে বাধ্য করা হতো। ফলে ব্যাংকের অভ্যন্তরে নৈতিকতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতিত হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর পর পরই বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের মাধ্যমে এস আলমের শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

তবে এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এস আলমের শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকের দায় পরিশোধের কার্যত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটি ব্যাংকের জন্য গুরুতর ঝুঁকি। কারণ এস আলম বিদেশে পালিয়ে গেলেও শেয়ার মালিকানার মাধ্যমে এখনও ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় তার উপস্থিতি রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থায় এস আলম যেকোনো সময় পুনরায় ব্যাংকের মালিকানা পুনর্গঠন করে ফিরে আসতে পারে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।

দায় পরিশোধে উদাসীনতা ও রহস্য : যদিও এস আলমের মালিকানাধীন শেয়ারগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৫,৬০০ কোটি টাকা, ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত সেগুলো বিক্রি বা বাজেয়াপ্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অনীহার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত স্বার্থ জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, কোনো বড় খেলাপি বা অপরাধীর মালিকানা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে দায় পরিশোধে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ হচ্ছে না, যা এক ধরনের নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বা মুনাফা থেকে লোকসানে : মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ইসলামী ব্যাংককে এখন বিশাল অঙ্কের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকটি গত কয়েক বছরে মুনাফা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথমবারের মতো সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে কোনো লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়নি। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, ব্যাংকটি এখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত।

পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের সুপারিশ : অর্থনীতিবিদ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী ব্যাংককে রক্ষা করতে এখনই কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। আর তা হলো, এস আলমের সব শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে বাজারে বিক্রি করতে হবে। প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের মন্দ ঋণ সমন্বয়ে ব্যবহার করতে হবে। এস আলমের সহযোগী পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত ও সম্পদ জব্দ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একসময় আস্থার প্রতীক ছিল। আজ সেটি দাঁড়িয়ে আছে এক কঠিন বাস্তবতার মুখে। একজন ব্যবসায়ী মাফিয়ার লোভ, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে। এস আলম ও তার দোসরদের নামে-বেনামে লুট করা এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা ফেরত না এলে ব্যাংকটি কেবল একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবেও হারাবে অস্তিত্ব। শেয়ার বিক্রি ও দায় সমন্বয়ের উদ্যোগ এখনই না নিলে, ইসলামী ব্যাংক পরিণত হবে একটি ‘মৃত প্রতিষ্ঠান’-এ যেখানে বাকি থাকবে শুধু নাম ও স্মৃতি।