অবৈধ নিয়োগে দাপুটে কর্মকর্তা- শেষ

ব্যাচের কমিটি, পদায়নের নিয়ন্ত্রণও করতেন তারা

শামছুল ইসলাম
Printed Edition

আওয়ামী লীগের আস্থাভাজনদের নিয়োগ দিতে এসআরও জারি করতেন শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ শেষ করার পর ৩১তম ব্যাচে অবৈধভাবে ২৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ক্ষমতায় থাকা সরকারের আশীর্বাদে ক্যাডার সার্ভিসে আসা এসব কর্মকর্তা ছিলেন শুরু থেকেই বেপরোয়া। তাদের দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন মেধা তালিকায় নিয়োগ প্রাপ্তরাও। প্রভাব খাটিয়ে ব্যাচের কমিটিতেও গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেন এসব কর্মকর্তা। ব্যাচের সহকর্মীদের কার কোথায় পোস্টিং হবে সেটিও নির্ধারণ করতেন তারাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩১তম বিসিএসের নিয়োগের প্রথম গেজেট হয় ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর, এর ৬ মাস পর পরের বছর ১২ জুন এই ভুয়া ক্যাডারদের নিয়োগের সুপারিশ করে গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার।

নিয়োগপ্রাপ্ত ২৩ জনের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১১জন, পুলিশ ক্যাডারে ৬ জন, ইকোনমিক ক্যাডারে ৩ জন, তথ্য ক্যাডারে ১ জন, পরিবার পরিকল্পনায় ১ জন এবং কর ক্যাডারে ১ জন নিয়োগ পেয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দলীয় বিবেচনায় এসআরওর মাধ্যমে যোগদান করে আকতারুন নেছা। ২০২৩ সালের ৬ সেপ্টম্বর ৩১তম বিসিএস অল ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের

২০১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির প্রথম নারী সম্পাদক নির্বাচিত হন এই কর্মকর্তা। এই কমিটি ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ওই নারী শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়ার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্বামীও একই ব্যাচের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের ঘনিষ্ঠ নাহিদ হাসান আছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে।

আকতারুন নেছা এর আগে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পরিকল্পনা বিভাগ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন।

একইভাবে নিয়োগ পাওয়া পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সাঈকা সাহাদাত। এই কর্মকর্তা কক্সবাজারের পেকুয়ার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে ১৫ টন ত্রাণ চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিললে তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে এই কর্মকর্তা মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার, ঘিওরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে চাকরি করেছেন।

একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম সালাউদ্দীন মনজু। এই কর্মকর্তাকে গত বছরে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে ৪২ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় ওএসডি করা হয়। ৪ মাস ওএসডি থাকার পর তাকে আবারো সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পদায়ন করা হয়। এর আগে এই কর্মকর্তা ঢাকার নবাবগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার, আমিন বাজার সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজ করেছেন।

একইভাবে নিয়োগ পান পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব এস এম সাদিক তানভীর। গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালে গাজীপুরে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ও সঠিক মালামাল ব্যবহার না করাসহ বেশ কয়েকটি অনিয়মের অভিযোগে এই কর্মকর্তাকে বরিশালে বদলি করা হয়। এই কর্মকর্তা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।

একইভাবে নিয়োগ পাওয়া গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করছেন এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম। এই কর্মকর্তা রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, তথ্য কমিশনের কমিশনারের একান্ত সচিব, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে চাকরি করেছেন।

একইভাবে নিয়োগ পেয়েছেন নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সোহেল রানা। এই কর্মকর্তা নোয়াখালী সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাকাডেমির উপপরিচালক হিসেবে চাকরি করেছেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম একইভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। এই কর্মকর্তা চাকরি জীবনে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের, সহকারী কমিশনার ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার, হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন।

চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শিরিন আক্তার একইভাবে ৩১তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। এই কর্মকর্তা নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক হিসেবে চাকরি করেছেন।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর বগুড়ার জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের চার্জ অফিসার মোছা, রওনক জাহান একইভাবে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরি জীবনে গাইবান্ধা সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, বগুড়ার গাবতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পাবনা জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা সুলতানা একইভাবে চাকরিতে যোগ দেন। এর আগে এই কর্মকর্তা পাবনার ভাঙ্গুড়া ও আটঘরিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন।

পটুয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তারেক হাওলাদার একইভাবে ইকোনমিক ক্যাডারে যোগ দেন। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব, ভোলার দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বরিশালের হিজলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন।

সরকারি যানবাহন অধিদফতরের ম্যানেজার ফজলুর রহমান একইভাবে ইকোনমিক ক্যাডারে যোগ দেন। এর আগে এই কর্মকর্তা বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ইকোনমিক ক্যাডারে সাইফুল ইসলাম যোগদান করলেও পরে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান।

পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেয়া ৬ জন হলেন- থান্ডার খায়রুল হাসান, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন, আমরীন খায়রুল, মো: শরিফুল আলম, মাহবুবুল হক সজীব এবং সুদীপ দাস।

তথ্য ক্যাডারে মাসুম বিল্লাহ, কর ক্যাডারে মো: রকিবুল হাফিজ এবং পরিবার পরিকল্পনায় মোহাম্মদ মিজানুর রহমান যোগদান করেন।