গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর গত বছর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত এক বছরে ব্যাংকিং খাতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার কার্যক্রম দেখা গেছে। বিশেষ করে অর্থপাচারকারীদের শান্তির ঘুম হারাম করে দেয়া হয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, বোন রেহেনা, শেখ পরিবারের সদস্যসহ ১১টি মাফিয়া ব্যাংক লুটেরা গ্রুপকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। এর বাইরে যারা অর্থ পাচার করেছিল, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে। প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার নগদ অর্থসহ সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বিদেশে থাকা সম্পদও জব্দের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থপাচারকারীরা বিদেশেও স্বস্তিতে নেই। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এস আলমসহ অনেকেই। অর্থ পাচারের অভিযোগে ব্রিটেনে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন শেখ পরিবারের এক সদস্য।
এ ছাড়া গত এক বছরে হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে টাকা পাচার বন্ধ হয়ে যায়, দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আসে। তলানিতে নেমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আবারো সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। যদিও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বৈদেশিক বকেয়া দেনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যাংক লুটেরাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পতিত রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে দখলে নেয়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা হয়েছে আট ইসলামী ব্যাংককে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে সালমান এফ রহমানের কাছ থেকে আইএফআইসি ব্যাংক, নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছ থেকে এক্সিম ব্যাংক উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলে ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।
গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরের যোগদান : বিধি অনুযায়ী ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায়। এর পরে প্রধান বিচারপতির ৬৭ বছরের মেয়াদকে রেফারেন্স ধরে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে গভর্নরের মেয়াদ ৬৭ বছর করা হয়। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাংক লুটপাটের বিরুদ্ধে সরব থাকা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনুসরকে বিশেষ আইনে ৭৩ বছর বয়সে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পেয়েই প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন, যারা ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করেছে ও অর্থ পাচার করেছে, তাদেরকে শান্তিতে ঘুমাতে দেবেন না।
কথা রেখেছেন গভর্নর, ঘুম হারাম পাচারকারীদের : তিনি দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংক ডাকাত এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আট ব্যাংকসহ ১৪ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেন। এর মধ্যে সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইএফআইসি ব্যাংক, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অর্থের জোগানদাতা ও দীর্ঘ দেড় যুগ চেয়ারম্যানের পদ দখলে থাকা নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের দখলে থাকা ইউসিবি ব্যাংক ও শিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক রয়েছে। পাশাপাশি যারা অর্থ পাচার করেছে তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুদক, সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে দেশী-বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয। শুরু হয় অর্থপাচারকারীদের দৌড়ঝাঁপ। দেশে থাকা সম্পদ আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়। এ পর্যন্ত নগদ অর্থসহ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বিদেশেও সংশ্লিষ্ট সরকারের মাধ্যমে পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করা হয়। পাচারকারীরা বিদেশে থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের আওতায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বড় অর্থ পাচারকারী এস আলম সিঙ্গাপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন। সেখানেও তিনি থাকতে পারেননি। বিভিন্ন দেশে এখন স্থান পাল্টাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে পাচারকারীরা সম্পদ বিক্রি করছে দেদারচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়ার অর্থ উদ্ধার ও তথ্য সংগ্রহে সহায়তা চেয়ে ২০০টিরও বেশি দেশে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ২৭টির জবাব পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। এভাবেই গত এক বছরে বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে থাকা অর্থপাচারকারীদের ঘুম হারাম করে দিয়ে কথা রেখেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর।
সন্তোষজনক রিজার্ভ ও স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজার : পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেদারচ্ছে অর্থ পাচার হয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির তথ্য মতে, দেশ থেকে দেড় দশকে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা। বিশেষ করে শেষ দুই বছরে বেশি অর্থ পাচার হয়। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ একপর্যায়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহ আসছে। পাশাপাশি কমে গেছে মুদ্রাপাচার। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে পৌঁছেছে। পাশাপাশি স্থিতিশীল রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। প্রতি ডলার এখন ১২২ টাকার মধ্যেই লেনদেন হচ্ছে।
প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বকেয়া কিস্তি পরিশোধ : অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৪.০৮৭ বিলিয়ন) বিদেশী ঋণের বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নজিরবিহীন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বিপর্যয় ও আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়মের মধ্যেও এই পরিশোধ সক্ষমতা বাংলাদেশের দায়বদ্ধতা ও আর্থিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার শক্ত প্রমাণ।
ব্যাংক রেজ্যুলেশন আইন ও টাস্কফোর্স গঠন : অর্থনৈতিক খাতে গঠনমূলক সংস্কার আনতে সরকার ২০২৫ সালে ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স’ জারি করেছে। এ আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো দুর্বল ব্যাংককে পুনর্গঠন, একীভূতকরণ বা দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে। একই সাথে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে ব্যাংকিং সিস্টেম পুনর্গঠন, খেলাপি ঋণ উদ্ধার এবং বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদের তথ্য সংগ্রহ ও ফিরিয়ে আনার জন্য।
আমদানি ব্যালান্স ও ডলার বাজার : এক দিকে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা হয়েছে, অন্য দিকে ওভার ইনভয়েসিং কমে আসায় মাসিক ৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানির মধ্যেও কোনো সঙ্কট তৈরি হয়নি। বাজারে ডলার ১২২ টাকাতেই স্থিতিশীল রয়েছে। রফতানি আয়ও আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।