অর্থনৈতিক রিপোর্ট
- কৃষিতে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ২ হাজার ৪.৮১ কোটি টাকার ঋণসুবিধা
- ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ৪০ হাজার ৪৭৫ জন গ্রাহক পেয়েছেন ৯০৩.৬০ কোটি টাকা
- চলতি বছরের ৯ মাসে প্রবাসী আয় সংগ্রহে কৃষি ব্যাংকের অবস্থান দ্বিতীয়
করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাতকে চাঙ্গা করতে ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তা থেকে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) এক লাখ ৩২ হাজার ৮০৯ জন নতুন কৃষককে দিয়েছে এই ঋণসুবিধা। ধান চাষ, মাছ চাষ, পোলট্রি, দুগ্ধ উৎপাদন, গরু মোটাতাজাকরণ, শাকসবজি, ফল ও ফুল চাষে এ তহবিল থেকে বিকেবি জামানতবিহীন সহজ শর্তে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ২ হাজার ৪ দশমিক ৮১ কোটি টাকা এই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ করেছে। যেখানে প্রায় অর্ধেকের বেশি সুদ ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের বেঁধে দেয়া সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। তবে বর্তমানে এই স্কিমের আওতায় ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ আগামী ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে স্বল্প সুদের এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কৃষি ব্যাংক লক্ষ্যের ৯৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বিতরণ করেছে।
কৃষিঋণের প্রণোদনা প্যাকেজের ২০২৫ সালের জুনভিত্তিক বিকেবির প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিকেবি স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করে সরকারি কৃষিনীতি বাস্তবায়ন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক লাখ ৭৮ হাজার ৩৮৬ জন নতুন কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। গত অর্থবছরে এসব নতুন কৃষকদের তিন হাজার ১১৬ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেয়া হয়েছে।
বিকেবি সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে কৃষি ব্যাংক নড়াইলের কালিয়া শাখাধীন প্রত্যন্ত কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক আনসার শেখ মাছ চাষে ৪ শতাংশ স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে মাছ উৎপাদন এবং উৎপাদিত মাছের ভালো দাম পাওয়ায় ঋণ পরিশোধের পর যে মুনাফা পেয়েছেন তা দিয়ে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা আগের চেয়ে ভালো খাবার ও পোশাকের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন। মুনাফার টাকায় নিজস্ব ঘরবাড়ি সংস্কার ও জমির মালিকও হয়েছেন তিনি।
নিজের সফলতার গল্পে তিনি জানান, ‘অভাবের সংসার কাটিয়ে এখন আমি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার সম্পদের মালিক।’ করোনার সময়ে কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তা থেকে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণসুবিধা নিয়ে গেল কয়েক বছরে অনেক কৃষকের জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তন এসেছে। আনসার শেখের মতো অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে জানান তিনি।
একই সাথে কৃষিঋণের পাশপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ বাংক কর্তৃক গঠিত ‘স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ তহবিলের মাধ্যমে গত অর্থবছরে চার হাজার ৯৭৮জন নারী উদ্যোক্তাকে ৫ শতাংশ সুদ হারে ২৩৫ দশমিক ৬২ কোটি অর্থায়ন করেছে বিকেবি। তাদের সবাই এখন স্বাবলম্বী। এখানে বিশেষ আর্কষণ রয়েছে নারীদের জন্য। কোনো নারী গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের দেয়া হয় এক শতাংশ প্রণোদনা বোনাস।
এ ছাড়া প্রণোদনা স্কিমের আওতায় করোনা মহামারীতে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচনে ‘ঘরে ফেরা’ নামে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ৬ শতাংশ সুদে ১৫ হাজার ৩৭৯ জন কর্মহীনকে দেয়া হয়েছে ২১৫ দশমিক ০৬ কোটি টাকা। জামানত ছাড়াই সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এসব কর্মহীনরা। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করার ধারাবাহিকতায় আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এসএমই ফাউন্ডেশনের অনুকূলে দুই ধাপে ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে গঠিত ‘রিভলভিং ফান্ড’ থেকে, এসএমই ফাউন্ডেশন অংশীদার ব্যাংক বিকেবির মাধ্যমে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) নতুন করে ৬ শতাংশ সুদে ৪১৪ জন উদ্যোক্তাকে ১৪ দশমিক ৪৪ কোটি ঋণ প্রদান করে। এ ছাড়া দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবার আওতায় আনতে আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম তথা ১০, ৫০ বা ১০০ টাকা হিসাবধারী প্রান্তিক, ভূমিহীন কৃষক, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, স্কুল ব্যাংকিং হিসাবধারী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত রিফাইন্যান্স স্কিমের আওতায় ৭ শতাংশ সুদহারে ৯ হাজার ৭৬৬ জন নিম্ন আয়ের পেশাজীবীদের ১৪৬ দশমিক ৪২ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেয়া হয়েছে।
সিএমএসএমই খাতে মেয়াদি ঋণের বিপরীতে ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ স্কিমের আওতায় সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ৯ হাজার ৯০৫ জন গ্রাহককে ৪৮০ দশমিক ৬০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে বিকেবি। তারা এ স্কিমের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২ শতাংশ সুদে রিফাইন্যান্স পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পুনঃঅর্থায়নের অর্থ সুদসহ কিস্তি আদায় করছে।
আমদানি বিকল্প শস্য তথা ডাল, তৈলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকার কর্তৃক ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ প্রদান করা হয়, যা দেশের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে এবং কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে দেয়। কৃষি ব্যাংক এই খাতে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চার হাজার ৩১১ জন কৃষককে মাত্র ৪ শতাংশ সুদহারে ৪৫ দশমিক ৭২ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিয়েছে।
এ ছাড়া কৃষি ব্যাংক পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও সাশ্রয়ী সবুজ গৃহায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে গঠিত ৪০০ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় গ্রাহক পর্যায়ে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে গত অর্থবছরে ২৫৪ জন নতুন উদ্যোক্তাকে ৯ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছে। তবে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক খাত কৃষিতে সোলার ইরিগেশনের ক্ষেত্রে সুদহার হচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ।