নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ৫ আগস্ট, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির দিনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই ভাষণেই তিনি ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট দিনণ ঘোষণা করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র।
১২ ফেব্রুয়ারি সম্ভাব্য তারিখ : নির্বাচন কমিশনের সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ তারিখে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে, যা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মাধ্যমেই সরকারিভাবে জানানো হবে। নির্বাচনের সময়সীমা ও রোডম্যাপ দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর একটি প্রধান দাবি ছিল। সরকারি ও রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন এবং ভোটের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় সময়রেখা তুলে ধরবেন। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের পর সরকারের নেয়া রাষ্ট্রীয় সংস্কার, যুদ্ধাপরাধ ও রাজনৈতিক সহিংসতার বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হবে।
জুলাই সনদ : ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ঐতিহাসিক দলিল : ৫ আগস্টের ভাষণের আগেই সরকার ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ করার পরিকল্পনা করছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে এই সনদে থাকবে, অভ্যুত্থানের পটভূমি ও কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের মূলনীতি ও নীতিগত অবস্থান, রাজনৈতিক সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন সংক্রান্ত মূল অঙ্গীকারগুলো।
কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদের একটি খসড়া ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখযোগ্য আপত্তি না উঠলে সেটি চূড়ান্ত করে ৫ আগস্টের আগেই প্রকাশ করা হবে। সনদে থাকবে “প্রাথমিক বক্তব্য, অঙ্গীকার, রাষ্ট্রগঠনের নীতিমালা ও নির্বাচনপূর্ব প্রক্রিয়ার কাঠামো।”
বিমান দুর্ঘটনার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জরুরি সংলাপ : রাজধানীর মাইলস্টোন কলেজে সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়। এই ঘটনার পরপরই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস টানা তিন দিন ধরে দেশের ১৩টি রাজনৈতিক দলের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করেন। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জানান, নির্বাচন প্রসঙ্গে মানুষের মধ্যে আবার সংশয় তৈরি হয়েছে, সরকারের উপর আস্থাও কমেছে।
বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন : “পতিত শক্তি নির্বাচন বানচালের জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারলে, এই বিরল সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।”
বৈঠকে অংশ নেয়া একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট তারিখ বলেননি, তবে তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন বলে আমাদের নিশ্চিত করেছেন।”
নির্বাচন : ফেব্রুয়ারি না এপ্রিল : প্রসঙ্গত, গত ৬ জুন ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস বলেছিলেন, নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে হবে। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে এ সময়সূচি প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু ঈদের পর লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মধ্যে আলোচনা হয়। ওই বৈঠক শেষে উভয় পক্ষ এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, “সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজন সম্ভব” যা ইঙ্গিত করে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধকে।
রাষ্ট্র সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি : অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুইটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে- রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও ২০২৪ সালের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিচার। রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের অগ্রাধিকার ছিল বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন, সামরিক তত্ত্বাবধান ও গণমাধ্যম স্বাধীনতা ইস্যু। এসব খাতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালা এখন কার্যত বাস্তবায়নের পথে।
অন্য দিকে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ওপর চালানো সহিংসতা এবং গুম-খুনের ঘটনায় দায়ীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকার আশা করছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় ২০২৫ সালের মধ্যেই ঘোষণা করা যাবে।
ড. ইউনূস ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ দীর্ঘ করবেন না : সরকারি সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে নন। বরং তিনি চান, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই সরকারের মৌলিক কাজগুলো শেষ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে।
৫ আগস্টে নির্ধারক বার্তা : ৫ আগস্টের ভাষণ তাই শুধু একটি নির্বাচনের সময় ঘোষণা নয়, এটি হবে- গণ-আন্দোলনের ল্েযর বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি, অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা ও দায়বদ্ধতার পর্যালোচনা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সমাপ্তি ঘটানোর দিকনির্দেশনা। এমন পরিস্থিতিতে পুরো জাতির চোখ এখন ৫ আগস্ট দিনটির দিকে তাকিয়ে।