লালমনিরহাটে কোটি টাকার মাদক ও গরু অনুপ্রবেশ

অরক্ষিত সীমান্তপথ

আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট
Printed Edition

শীতের আগমনকে পুঁজি করে লালমনিরহাটের ৭৪ কিমি. অরক্ষিত সীমান্তপথে প্রতি রাতে কোটি টাকার ভারতীয় মাদক ও গরু প্রবেশ করছে। এ কাজে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমল থেকেই বেশ সক্রিয় হয়ে আছে। দফায় দফায় পুলিশ, বিজিবি, মাদকদ্রব্য অধিদফতরের অভিযান, গ্রেফতার, মামলার পরও সীমান্ত দিয়ে মাদক ও গরু পাচারের বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। যে কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে সীমান্ত হত্যা।

‘অধিকার’ নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে বিএসএফের সদস্যদের হাতে অন্তত ৫৮২ বাংলাদেশীর মৃত্যু ও ৭৬১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আট বছরে লালমনিরহাট সীমান্তে ৩৫ বাংলাদেশীকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি করে হত্যা করে।

জানা যায়, দেশের উত্তরে সর্বশেষ ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা জেলার নাম লালমনিরহাট। পাঁচটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ জেলার পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি তিস্তা থেকে বুড়িমারী স্থলপথ প্রায় ১২০ কিমি.। মোট সীমান্তপথ ২৮৪ কিমি. হলেও ৭৪ কিমি. অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। পানিবেষ্টিত সীমান্ত ২৪ কিমি.। কাঁটাতারবিহীন সীমান্ত এলাকাগুলো হলো পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার দইখাওয়া, কালীগঞ্জের চাপারহাট, গোড়ল, কুটিয়ামঙ্গল, আদিতমারীর দুর্গাপুর ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট। সীমান্ত উন্মুক্ত থাকায় দুই দেশের মানুষ অরক্ষিত সীমান্ত পথে গবাদিপশু, মাদকদ্রব্য পাচার, আত্মীয়র সাথে দেখা ও খোঁজখবর নিতে সহায়তা করতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা শীতের সময়ে ঘন কুয়াশার আড়ালে এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) ম্যানেজ করে প্রতি রাতে এক ঘণ্টার একটি সুযোগ নিয়ে থাকে। এ সময় তারা ফেনসিডিল, ট্যাপেন্টাডল, গাঁজা, ইয়াবা, ভারতীয় মদ, স্কাফ সিরাপ ও ভারতীয় গরু সীমান্ত পার করে থাকে। চোরাই পথে আসা ভারতীয় গরুগুলো স্থানীয় হাটবাজারে দেশী গরুর সাথে একত্রে বিক্রি করা হয়। পরে প্রকাশ্যে ট্রাক ভর্তি করে গরুগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। মাঝে মধ্যে নির্ধারিত ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে এবং পাচার কার্যক্রম তখনো চলমান থাকলে বিএসএফের বিতর্কিত ‘শুট অন সাইট’ নীতিতে পড়ে যায়। যার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটে সীমান্তে হত্যা।

একটি সূত্র জানায়, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার সীমান্তে বিজিবির অভিযানে মাঝে মধ্যে ভারতীয় মাদক ও গরু আটক হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে এটা অযুহাত মাত্র। এক জোড়া ভারতীয় গরু সীমান্ত পার হয়ে ভেতরে ঢুকলে রক্ষীবাহিনী, অন্যান্য বাহিনী এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের রেসিও অনুয়ায়ী অর্থ পেয়ে থাকেন। এই অবৈধ অর্থের কারণে সীমান্ত সংলগ্ন হাটের ইজারাদার চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। অনেকে গরু ব্যবসার পাশাপশি হুন্ডির ব্যবসাও করছেন। এভাবে চোরাইপথে গরু আসার কারণে দেশীয় খামারগুলোতে গরু পালনে লাভবান হতে পারছেন না খামারিরা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় সীমান্ত এলাকার কিছু নেতাকর্মীর আশ্রয়ে গড়ে ওঠে এক শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। শীতের আগমন ও ঘন কুয়াশাকে পুঁজি করে জেলাজুড়ে অরক্ষিত সীমান্তপথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভারতীয় বিএসএফকে ম্যানেজ করে প্রতি রাতে মাত্র এক ঘণ্টায় কোটি টাকারও বেশি ভারতীয় মাদক ও গরু ঢুকছে বাংলাদেশে। অরণ্য স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক আনজুরুল হক সরকার মিন্টু বলেন, গুটি কয়েক মাদককারবারির কারণে এলাকার শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এমনকি গ্রামগুলোর নামে সাথেও এখন মাদকের ট্যাগ লেগে গেছে। পুলিশি অভিযান আরো জোরদার করার দাবি জানান তিনি। এ বিষয়ে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম বলেন, জেলাকে মাদক মুক্ত করতে অভিযান অব্যাহত আছে। স্বল্প জনবল নিয়েও পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে মাদক জব্দ ও কারবারিদের গ্রেফতার করছে।