বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি, মুদ্রাস্ফীতি, প্রধান বাজারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-যুগের শুল্কনীতি পুনরুজ্জীবনের ফলে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক (আরএমজি) রফতানি বড় ধাক্কার মুখে পড়েছে। চার মাস ধরে টানা রফতানি আয় কমছে। এমন পরিস্থিতিতে এতে উদ্বেগ বাড়ছে পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোক্তাদের অগ্রাধিকার বদলে যাওয়ায় পোশাকের চাহিদা কমেছে, আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে তৈরী পোশাক অর্ডার বুকিংয়ে।
দেশের রফতানিকারকরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হওয়ায় বৈশ্বিক ফ্যাশন সেক্টরে সরবরাহ চক্রের ব্যয় বেড়েছে। এতে ক্রেতারা অর্ডার কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। আগে যেখানে তিন ইউনিট পণ্য অর্ডার হতো, এখন তা এক ইউনিটে নেমে এসেছে। বিশেষ করে মূল ও মাঝারি দামের পণ্যের চাহিদা কমেছে বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র- এই তিন প্রধান বাজার থেকে অর্ডারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা চার মাস রফতানি আয় হ্রাস পেয়েছে। ২০২৫ সালের নভেম্বরে তৈরী পোশাক রফতানি আয় হয়েছে ৩.১৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ কম। অক্টোবর ২০২৫-এ আয় দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছিল ৩.৩০ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ের তুলনায় ৮.৩৯ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরে রফতানি কমেছে ৫.৬৬ শতাংশ এবং আগস্টে কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই সময়টায় বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য বেশি অর্ডার আসে। কিন্তু এবার সে তুলনায় অর্ডারের পরিমাণ দৃশ্যমানভাবে কম। তার মতে, এখন পর্যন্ত অর্ডার কমেছে অন্তত ৫.১০ শতাংশ। বিশেষ করে নিটওয়্যার ও বেসিক আইটেম উৎপাদনকারীরা সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ক্রেতাদের বাজেট বাড়েনি, কিন্তু শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই তারা তাদের অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। আগে যেখানে তিনটি কিনতেন, এখন একটি কেনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তার মতে, শিশুদের পোশাক, নারীদের পোশাক এবং উচ্চ-মূল্যের পণ্যের অর্ডার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও বেসিক ও মাঝারি দামের পণ্যে চাহিদা সঙ্কোচন গভীর।
রফতানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো মারাত্মক সঙ্কটে পড়বে। কম-মুনাফার পণ্যের ওপর নির্ভরশীল কারখানাগুলো টিকে থাকতে সমস্যায় পড়বে এবং কর্মসংস্থানেও চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারের চিত্রও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ম্যাককিনজি অ্যান্ড কোম্পানির ‘স্টেট অব ফ্যাশন ২০২৬’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোক্তাদের আস্থা ও ব্যয় করার সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ ২০২৫ সালেও বিরাজমান ছিল এবং তা ২০২৬ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে। প্রতিবেদনটি বলছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭০ শতাংশ স্টেকহোল্ডার ভোক্তা ব্যয় সক্ষমতাকে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও বড় চ্যালেঞ্জ।
২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক আমদানি শুল্ক আরোপ করে, যা পোশাক ও চামড়াজাত পণ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ায় জটিলতা বেড়েছে আন্তর্জাতিক সরবরাহচক্রে। এমন পরিস্থিতিতে ব্র্যান্ডগুলো তাদের লাভজনক ধারা অব্যাহত রাখতে সরবরাহকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষি, লজিস্টিক ব্যয় কমানো, শিপমেন্ট একত্রীকরণ এবং পণ্যের পরিসর সঙ্কুচিত করার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক চাহিদা ও বাণিজ্যনীতির পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আরএমজি রফতানি বাড়তি চাপে আছে। এ অবস্থায় নতুন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে দেশটি। ইউরোপে ভারতের ও চীনের রফতানি দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক এড়াতে তারা বেশি পরিমাণ পণ্য ইউরোপে পাঠাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের বাজার অংশীদারিত্ব চাপে পড়ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রভাব শুধু আমেরিকাতেই নয়, ইউরোপেও পড়ছে। তিনি বলেন, ভোক্তাদের ক্রয় আচরণ পাল্টে গেছে। তারা এখন সেল বা ডিসকাউন্টের অপেক্ষায় থাকছে, নিয়মিত দাম দিয়ে পণ্য কিনছে কম। ব্ল্যাক ফ্রাইডের মতো বড় ছাড়ের ইভেন্টগুলো ক্রয়চাহিদায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে বলে তিনি মনে করেন।
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, চীন ও ভারতের রফতানিকারকরা ইউরোপে আক্রমণাত্মকভাবে প্রবেশ করছে। এতে বাংলাদেশী পোশাক নির্মাতারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছেন। ক্রেতারা অর্ডার কমাচ্ছে, তার ওপর প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
একটি বহুজাতিক ক্রয় এজেন্সির ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান, যিনি পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি, বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৈশ্বিক ক্রয় আচরণ পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ভোক্তারা কম পোশাক কিনছে, ফলে আমাদেরও অর্ডার কমিয়ে আনতে হচ্ছে।’ তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের অর্থনৈতিক চাপ পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করেছে। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে দুর্বল করছে। জাতিসঙ্ঘের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমে ২.৪ শতাংশে নামতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে কম। এটি মন্দা নয়, তবে একটি দীর্ঘায়িত ধীরগতি, যার প্রভাব সব দেশেই পড়ছে। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর মনে করেন, প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে এবং নতুন অর্ডার টানতে বাংলাদেশকে উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা ও বাজার বৈচিত্র্যে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যে পরিস্থিতি, তাতে আমাদের আরো দক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক ও উদ্ভাবনী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক, মঈনউদ্দিন রুবেল বলেন, সরকার কিছু নীতিগত সহায়তা ফিরিয়ে আনলে শিল্পটি আস্থা ফিরে পাবে। নতুন বাজারে রফতানির জন্য আমরা আগে চার শতাংশ ইনসেনটিভ পেতাম, এখন তা দুই শতাংশে নেমেছে। আগের সহায়তা থাকলে আমরা ক্রেতাদের কিছু বাড়তি সুবিধা দিতে পারতাম।’ তার মতে, বৈশ্বিক বাজারে দাম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রণোদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক বাজারে ওঠানামা থাকলেও বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে নিটওয়্যার সেগমেন্টে অর্ডার কমে যাওয়া একটি সতর্ক সঙ্কেত। তিনি বলেন, নতুন বাজার খোঁজা, পণ্যে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৯.৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরী পোশাক রফতানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৮৪ শতাংশ বেশি। তবে চলমান চাহিদা সঙ্কোচন ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা সামনে রেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে তারা মনে করেন।


