অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে ছেড়ে যেতে পারি না। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের ড. ইউনূসের এ কথা জানান।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন ‘উনি (ইউনূস) তো চলে যাবেন বলেননি। উনি বলেছেন, আমরা যে কাজ করছি, আমাদের ওপরে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব, পালন না করে তো আমরা যেতে পারব না।’ প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না বলেও জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
এ দিকে গতকাল শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, অর্পিত দায়িত্ব পালন অসম্ভব করলে জনগণকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিবৃতি উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচারপ্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
গতকাল বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এই বিবৃতিটি গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো হয়েছে।
বিবৃতি বলা হয়েছে, গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব (নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় পরিকল্পনা কমিশনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ার বহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে। দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, শত বাধার মধ্যেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
এ দিকে পরিকল্পনা উপদেষ্টা একনেকের বৈঠকের বিষয় আলোচনার পর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এ দায়িত্ব পালনে যেসব প্রতিবন্ধকতা আসছে, সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো আমরা আলোচনা করেছি। আমরা প্রত্যেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে গেলে কী কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, সেগুলো আমরা দেখছি।
তিনি বলেন, বড় পরিসরে আগামী নির্বাচন এবং সুশাসিত গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণের জন্য যে ধরনের একটা ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার; সেই কাজ তো আমাদের আসল কাজ। সে কাজেও কী কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসছে, সেগুলো আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।
ড. ওয়াহিদ আরো বলেন, আমরা আহ্বান জানাব গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে, রাষ্ট্রীয় সব সংস্থাকে আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য। এটা তো আমাদের একার দায়িত্ব না। আমাদেরকে এখানে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আমরা তো স্বপ্রণোদিত হয়ে এখানে আসিনি এবং আমরা এ দায়িত্ব ছেড়েও যাবো না।’
উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর আগারগাঁও এনইসি সভাকক্ষে গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হয়। একনেক বৈঠকের পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপদেষ্টাদের সাথে আলাদা বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। ১৯ জন উপদেষ্টা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এ দিকে আলজাজিরার এক বিশ্লেষণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় সশস্ত্রবাহিনীর সাথে অন্তর্বর্তী সরকারে মধ্যে বোঝাপড়ায় দূরত্ব তৈরি হচ্ছে কি না এমন প্রশ্ন তুলে বলা হয়েছে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশ্লেষণে রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় তা অনুসন্ধানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি।
এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, ‘জুলাইয়ের বিদ্রোহের পর সব দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন করার জন্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু বিএনপি পেশিশক্তির ওপর ভিত্তি করে পুরনো কৌশলে অটল ছিল এটাই সঙ্কটের মূল। তিনি ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, জাতীয় স্বার্থে বিএনপি এবং অন্য সব দলকে একত্রিত হতে হবে।’
তবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আলজাজিরাকে বলেন, তার দল কখনই অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চায়নি। জনগণ তাদের ভোট দেয়ার এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রায় দুই দশক ধরে তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, আমরা আশা করি তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যাবেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এভাবেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন।
খসরু বলেন, বিএনপি চায় প্রশাসন তত্ত্বাবধায়ক মোডে চলে যাক- একটি দুর্বল উপদেষ্টা এবং কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে অপসারণ করা হোক, বিশেষ করে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদেরকে। তারা ইতোমধ্যেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, দলীয় বক্তব্য দিয়েছে। তিনি সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে যেকোনো দ্বন্দ্ব উড়িয়ে দিয়ে বলেন, উভয় একই সাথে এগোতে পারে।
আলজাজিরার সাথে আলাপকালে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন : ‘যাই হোক না কেন, আমরা বিশ্বাস করি ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জনগণ উভয়ের কাছ থেকে বিশাল প্রত্যাশা রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি আলজাজিরাকে বলেন যে, ইউনূসের পদত্যাগের আলোচনা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে ক্রমবর্ধমান হতাশার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা স্বার্থান্বেষীদের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে, পদত্যাগের আলোচনা সেই ঐক্য পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়ার একটি সঙ্কেত হতে পারে।
এনসিপির নাহিদ ইসলাম একটি ফেসবুক পোস্টে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণকে নাশকতা করার এবং আরেকটি ১/১১ ধাঁচের ব্যবস্থা করার ষড়যন্ত্র চলছে।
এ দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি ফেসবুক সতর্কতা জারি করে, যেখানে এক দিন আগে প্রচারিত একটি মিডিয়া বিজ্ঞপ্তির সত্যতা অস্বীকার করা হয়েছে, যেখানে সামরিক বাহিনীর লোগো ব্যবহার করে সশস্ত্রবাহিনী এবং জনসাধারণের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং ফাটল তৈরির স্পষ্ট প্রচেষ্টা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে সতর্ক করা হয়েছে, ‘গুজবে বিশ্বাস করবেন না। বিভ্রান্ত হবেন না।’
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অচলাবস্থা এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, বেসামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য সেনাবাহিনীর দীর্ঘায়িত মোতায়েনের ফলে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তার মন্তব্য ইউনূস প্রশাসনের ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার সাথে মতবিরোধের ইঙ্গিত দেয়, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কারের জন্য সময় দেয়া হয়।
সেনাপ্রধান নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়া অন্যান্য সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন- যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাব্য বিদেশী ব্যবস্থাপনা এবং ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংক চালু করা অন্তর্ভুুক্ত রয়েছে- যা তার মতে, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে আপস করা হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, জেনারেল ওয়াকারের দৃঢ় প্রকাশ্য বিবৃতি- এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া আর জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর জোর দেয়ার সময়- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্প্রসারিত বেসামরিক উদ্যোগের কারণে সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তির ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাপকভাবে দেখা হচ্ছে।