মুফতি ছাঈদ আহমাদ মোজাদ্দেদী
সিরাতুন্নবী হলো রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনবৃত্তান্ত। রাসূলুল্লাহ সা: এর জীবন বৃত্তান্ত ও আল কুরআন থেকেই ঈমানী ও ইসলামী জিন্দেগি গ্রহণ করতে হয়। সিরাত অর্থ স্বভাব, চরিত্র, তরিকা, অবস্থা, চাল-চলনের রীতিনীতি ও জীবন চরিত।
সিরাতুন্নবী অর্থ মহান আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা:-এর জীবণ চরিত। হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহ তায়ালার নবী ও রাসূল। আল্লাহ তায়ালাকে মেনে চলার একমাত্র পথ রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুকরণ অনুসরণ ও আনুগত্য।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর যথাযথ আনুগত্যের প্রয়োজনেই তাঁকে জানতে হবে। তাঁকে জানবার ও বুঝবার নির্ভরশীল প্রধান ও প্রথম সূত্র হলো আল-কুরআন আর দ্বিতীয় সূত্র হলো হাদিসে রাসূল। সহজে রাসূলুল্লাহ সা: ও তার জীবনাদর্শ সম্পর্কে জ্ঞান চর্চায় পবিত্র উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআন ও হাদিস বিশারদ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ রাসূলুল্লাহর জীবন চরিত বা সিরাতুন্নবী লিখেছেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন চরিত সম্পর্কীয় গ্রন্থাবলির অধ্যয়ন ও আলোচনা পৃথিবীর সর্বত্র ইসলামী জীবনাদর্শের প্রচার প্রসারে যে অতি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কুফর, শিরক, মানুষে-মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি ও খুন-খারাপি ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহিতার চক্রান্ত, সুদখোরি, ঘুষখোরি, মদ-জুয়া, জিনা-ব্যভিচার, জুলুম-অত্যাচার, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়ভাবে পর সম্পদ আত্মসাৎ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও পর্দাহীনতা ইত্যাদি জঘন্য ধরনের অন্যায় ও অপরাধ প্রবণতার কালিমায় কলঙ্কিত মানবসমাজকে শোধরিয়ে আনার-বিভ্রান্ত ও অশান্ত মানব গোষ্ঠীকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে শান্তি প্রদর্শনের পথ মাত্র একটিই। আর তা হলো মহান আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পবিত্র জীবন চরিতের আলোকে সমাজ গঠন। সিরাতুন্নবীর গবেষণা, উপলব্ধি, আলোচনা ও অনুসরণ যে বিশ্ব মানবতার মুক্তির একমাত্র সঠিক দিশারী তা জাতিধর্ম নির্বিশেষে শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী-গুণীগণের প্রায় সবাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বীকার করে আসছেন। আসল কথা হলো প্রকৃত অর্থে মুসলমান তাদের দৃষ্টিতে সিরাতুন্নবীর অধ্যয়ন ও প্রচার প্রসার এক অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহামর্যাদার অধিকারী সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহেদিন, মুহাদ্দেছিন ও আরেফবিল্লাহ অলিগণ ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথের পাথেয় হিসেবে যা কিছু লাভ করেছেন, তা সিরাতুন্নবীর আলোকেই লাভ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সিরাত বা জীবন চরিত সম্পর্কে যাদের অজানা রয়ে গেছে কিংবা যারা বৈষয়িক জীবনের ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের পেছনে সিমাহীন ছোটাছুটি করতে গিয়ে আল্লাহ, পরকাল ও মৃত্যুকে ভুলে গেছে অথবা শিরক ও বিদআতের বিষাক্ত কালিমায় যারা নিজেদের অন্তরাত্মাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলেছে কিংবা নাস্তিকতার গহিন সমুদ্রে যারা হাবুডুবু খাচ্ছে, কেবল তারাই পবিত্র সিরাতুন্নবী বা সিরাতে মুহাম্মাদির বিরোধী মতামত পোষণ করতে পারে। আর পারে সিরাতুন্নবীর চর্চা বন্ধ করে মানবসমাজকে শিরক, কুফর, বিদআত ও অপরাধ প্রবণতার গোমরাহির সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়ার চক্রান্ত আঁটতে। কিন্তু কোনো ঈমানদার মুসলমান সিরাতুন্নবীর বিরোধী মতামত পোষণ করতে পারে এটা কল্পনাও করা যেতে পারে না
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রশংসায় পবিত্র কুরআন মাজিদে এরশাদ করেছেন-
‘হে রাসূল নিশ্চয়ই আপনি চারিত্রিক উত্তম ও সৎ-গুণাবলির সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।’ (সূরা আল কালাম, আয়াত: ৪)
বিশ্ব মানবতাকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন পদ্ধতিতে তোমাদের (মানবসমাজের) জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। (তবে রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শের অনুকরণ ও অনুসরণ) সেসব লোকের জন্যই কল্যাণকর হবে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখবে আর অধিক হারে আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকবে।’ (সূরা আহযাব, আয়াত ২১)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সিরাত বা জীবন চরিতের অনুসরণ সৃষ্টি জগতের জন্য মহান আল্লাহর রহমত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
‘(হে রাসূল) আমি আপনাকে সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত করে পাঠিয়েছি।’ (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)
রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন- আমি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলির পরিপূর্ণতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি। এ হলো কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রশংসিত সিরাত আলোচনার ভিত্তি।
মিলাদুন্নবী সা: হাদিসের কিতাব-তিরমিজি শরিফের ২য় খণ্ডের শেষের দিকে ২০৩ পৃষ্ঠায় মিলাদুন্নবী অধ্যায়ে উল্লেখিত একটি হাদিস নিম্নরূপ:
‘হজরত ওসমান বিন আফফান (রা:) লায়ছ বংশীয় ইয়ামার গোত্রের কুবাসকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে কুবাস বলত, তুমি বড় না রাসূলুল্লাহ সা: বড়? উত্তরে কুবাস বলে ছিলেন- রাসূলুল্লাহ সা: আমার থেকে বড় আর জন্মের সময়কালের দিক থেকে আমি তার চাইতে অগ্রগামী (অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর পূর্বে জন্মপ্রাপ্ত হয়েছি ঠিকই কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা: আল্লাহর রাসূল হওয়ার কারণে মর্যাদার দিক থেকে আমার থেকে বড়)। আমি আবাবিল পাখির মল সময়ের ব্যবধানে সবুজ বর্ণে পরিণত অবস্থায় দেখেছি। এ হাদিসে রাসূলুল্লাহ্ সা:-এর জন্মগ্রহণের সময়-কাল সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। হাতির পিঠে চড়ে হাতিবাহিনী নিয়ে আবরাহা বাদশাহ পবিত্র কাবা শরিফ ধ্বংস করতে এসেছিল। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় আবাবিল পাখির ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপে আবরাহার সেনাবাহিনী ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। আর রক্ষিত হয়েছিল পবিত্র খানায়ে কাবা।
ঘটনার ৫০ কিংবা ৫৫ দিন পর সে বছরই রবিউল আউয়াল মাসের ৯ মতান্তরে ১২ তারিখ জন্ম প্রাপ্ত হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সা:।
এ রাসূলুল্লাহ সা:-এর জন্মকালের আলোচনায় লক্ষ্য করলে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জন্মের স্থান কাল পাত্র নিয়েআলোচনাই মিলাদুন্নবীর প্রধান বিষয়বস্তু। সাধারণত যেকোনো সন্তানের জন্মেই তার পিতা-মাতাও আত্মীয়স্বজন আনন্দিত হয়। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ব্যাপারেও তাই হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর চাচা আবু লাহাব আপন ভাতিজার জন্মের সংবাদ শুনে আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে আপন বাঁদি ছুয়াইবাকে আযাদ করে দিয়েছিল। ছুয়াইবা প্রথমদিকে রাসূলুল্লাহ্ সা:কে তার স্তন থেকে দুধ পান করিয়েছিল।
ঈদ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো আনন্দ করা, উৎসব করা। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জন্মের সুসংবাদে আবু লাহাব যা করেছিল তা আরবি ভাষায় ঈদে মিলাদে মুহাম্মদী অর্থাৎ মুহাম্মদ সা:-এর জন্ম-উৎসব।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবীগণ আমাদের সমাজে প্রচলিত নিয়মে মিলাদুন্নবী বা ঈদে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান করেছেন বলে কোনো প্রমাণ নাই। তথাপি তারা পবিত্র কুরআন মাজিদ ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর হাদিস দ্বারা স্বীকৃত মহামর্যাদার অধিকারী মুসলমান। আর তা এজন্য যে তারা তাওহিদ ও রিসালাতসহ পূর্ণ সিরাতুন্নবী গ্রহণ করেছেন। বিশ্ব মানবতার শিক্ষণীয় সব কিছুই সিরাতুন্নবীর ভেতর নিহিত। তাই সঠিক ঈমানী ও ইসলামী জিন্দেগির পক্ষে সিরাতুন্নবীর চর্চা এক অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী বিষয়। মিলাদুন্নবী অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা:-এর পিতা মাতার ঔরসে জন্ম প্রাপ্তির স্থান কাল পাত্রের বিষয়টি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিষয়। আর সিরাতুন্নবী হলো রাসূলুল্লাহ সা:-এর গোটা জীবন প্রবাহের মহাসমুদ্র। যারা সিরাতুন্নবী লিখেছেন তারা রাসূল সা:-এর জন্ম প্রাপ্তি অর্থাৎ মিলাদুন্নবীর আলোচনাকে সিরাতুন্নবীর সাথে সংযুক্ত করেছেন। দুইমণি বস্তায় প্রায় সবটাই বালু, তাতে শুধু এক/দু কেজি চিনি ঢেলে দিয়ে চিনির বস্তা বলে চালিয়ে দিতে চায়। এটা হলো সিরাতুন্নবী প্রত্যাখ্যান করে শুধু মিলাদুন্নবীর পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ। ইসলাম বিবর্জিত ঢের ক্রিয়াকলাপের মুখে সিরাতুন্নবীকে প্রত্যাখ্যান করে মিলাদুন্নবীর সংক্ষিপ্ত বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাতিল উদ্দেশ্যকে চাপা দেয়ার জঘন্য অপকৌশল ফাঁস হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
এ কথা সবারই জানা থাকতে হবে এবং মেনে নিতে হবে যে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ২৩ বছরের নবুওয়তি জিন্দেগির সিরাত গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যানের সাথেই মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য অথবা ব্যর্থতার সম্পর্ক জড়িত।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমান রেখে তার সিরাতের স্বীকৃতি ও আনুগত্যের সাথে যদি তার জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে বিদআতমুক্ত পরিবেশে সঠিক পন্থায় আলোচনা করা হয় এবং তা বিশুদ্ধ হাদিস ও সঠিক ইতিহাসভিত্তিক হয় তা অবশ্যই বরকতময় নেক কাজের শামিল। অবশ্য এর সাথে নেককাজের আদেশ ও গুনাহর কাজে বাধা সম্পর্কীয় আলোচনা এবং সালাম ও দরূদ শরিফ যোগ করা বাঞ্ছনীয়। এ ধরনের মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। মিলাদুন্নবী অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন-বৃত্তান্ত নিয়ে প্রামাণ্য আলোচনায় অতি সহজে একটি শিরকি আকিদার খণ্ডন হয়ে যায়। মিলাদুন্নবী প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ সা: আল্লাহর জাত বা সিফাতি নূরের অংশ নহেন। আর এটা এভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি আদম (আ:) এর বংশে আপন পিতা-মাতার ঔরসে জন্ম প্রাপ্ত সন্তান বলেই
তার নামে মিলাদ অনুষ্ঠান হয়। আর আল্লাহ তায়ালার পরিচয়ের ক্ষেত্রে মিলাদে এলাহী বা অন্য কোনো নামে আল্লাহর মিলাদ অনুষ্ঠান হতে পারে না কারণ আল্লাহ তায়ালার পরিচয় হলো তিনি-
‘তিনি কোনো সন্তান জন্ম দেন নাই, আর তিনি জন্মপ্রাপ্ত ও হন নাই।’ (সূরা ইখলাস, আয়াত : ৩)
আল্লাহ তায়ালা জন্মদাতা নহেন, তিনি সৃষ্টিকর্তা। আর রাসূলুল্লাহ সা: হলেন আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তায়ালার সত্তায় কিংবা বিশেষ কোনো গুণে কারো কোনো প্রকার অংশীদারিত্বের আকিদা-বিশ্বাস অবশ্যই শিরিক।