উত্তপ্ত পাহাড় : সংঘর্ষে নিহত ৩

ইয়ান ইয়ানের পোস্ট ও ইউপিডিএফের সহিংসতা তিন পার্বত্য জেলায়

এস এম মিন্টু
রফিকুল ইসলাম রকি, খাগড়াছড়ি
বেলাল হোসাইন, রামগড় (খাগড়াছড়ি)
Printed Edition
খাগড়াছড়ির গুইমারে একটি বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা : নয়া দিগন্ত
খাগড়াছড়ির গুইমারে একটি বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা : নয়া দিগন্ত

খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় সহিংসতা চলাকালে দুষ্কৃতিকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। এ সময় মেজরসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য, সাংবাদিক এবং আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ঘটনার বিষয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিবৃতিতে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগিরই তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেয়া হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণপূর্বক শান্ত থাকার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুপুরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গুইমারার রামসু বাজারের মুখে অবরোধের সমর্থনে সড়কে গাছের গুঁড়িতে আগুন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন অবরোধকারীরা। খবর পেয়ে সিন্দুকছড়ি সেনা জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর মো: মাজহার হোসেন রাব্বানীসহ সেনাসদস্যরা সেখানে গিয়ে তাদের সড়ক থেকে সরে যেতে বলেন। এ নিয়ে অবরোধকারীদের সাথে সেনাসদস্যদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সেনাসদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। তখন অবরোধকারীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। এতে মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য এবং সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।

অবরোধকারীরা রামসু বাজারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে সমাজসেবা অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়সহ বেশ কিছু অফিস, দোকান, বসতঘর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ছোড়ে।

এ দিকে দুপুরে সংঘর্ষের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়া এক লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, ভিডিওকারী বলছেন, ইউপিডিএফ আমাদের ওপর গুলি করছে। গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনামুল হক চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি অনেকটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আতঙ্কিত না হয়ে লোকজনকে ১৪৪ ধারা মেনে চলতে বলা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের বলেন, গুইমারা থেকে তিনজনের লাশ এসেছে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে। লাশগুলো মর্গে রাখা হয়েছে। সোমবার সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে। এ দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, আমি এসপিসহ ঘটনাস্থলে অবস্থান করছি। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত আছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জেলা সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণীর এক মারমা শিক্ষার্থীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় শয়ন শীল (১৯) নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনসহ শনিবার সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ ডাকা হয়। অবরোধ চলাকালে জেলা শহরে পাহাড়ি-বাঙালি দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ২৩ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। শনিবার দুপুর থেকে খাগড়াছড়ি পৌরসভা, সদর উপজেলা ও গুইমারা উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে। মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি।

শনিবার রাতে আবারো ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নতুন করে সড়ক অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হলেও কিছুক্ষণ পর তা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। ১ ঘণ্টা পরে পুনরায় অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আসে।

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : সিন্দুকছড়ি সেনাজোনের উপ-অধিনায়ক মেজর মো: মাজহার হোসেন রাব্বানী জানান, সেনাসদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত করতে গেলে বিনা উসকানিতে সশস্ত্র হামলার মুখে পড়েন। অবরোধকারীরা পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০-২৫ জন থেকে কয়েক শত জন পরিণত হয়ে সেনাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। গুইমারা ইউএনও আইরিন আক্তার বলেন, “পরিস্থিতি এখনো থমথমে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ঘটনায় মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন। দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।

মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে জনসাধারণকে গুজবে কান না দেয়ার ও নিজ নিজ এলাকা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে। ইউএনও তাহমিনা আফরোজ ভুঁইয়া বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এ দিকে মারমা উন্নয়ন সংসদ ও বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদ এক যৌথ বিবৃতিতে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারের আড়ালে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ি জনগণকে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। তারা প্রশাসনের প্রতি ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার ও সকল পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের অভিযোগ : পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, পাহাড়ে সরকারি বাহিনীর বাইরে কারো কাছে অস্ত্র থাকতে পারবে না। “ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলনের নামে সহিংসতার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে” বলে তিনি দাবি করেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

উসকানি ও ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর ছক : তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উনকানিমূলক মন্তব্য ছড়িয়ে চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে সংঘাত-সহিংতার সৃষ্টি করছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। বিশেষ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে এরই মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থার পরিণত হয়েছে। গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়িতে এক মারমা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার সত্যতা পায়নি চিকিৎসকরা। কথিত ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে পুরো পার্বত্যাঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি ভঙ্গ করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারসহ, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দোকানপাটে লুটপাট ও পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের ওপর হামলাসহ চরম অরাজতার সৃষ্টি করছে সেখানকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা। অবরোধ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, পার্বত্যাঞ্চলে অস্থিরতার নেপথ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও তাদের সহযোগী ছাত্র-নারী সংগঠনগুলো একের পর এক সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করছে। এই পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পাহাড়ে উতপ্ত ছড়াতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গ্রুপের উসকানিতে উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে।

বিদেশে বসে ইয়ান ইয়ানের উসকানিমূলক পোস্ট

নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চিত হয় যে উখ্যানু মারমা ইউপিডিএফের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উখ্যানু মারমাকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় যাতে অরাজকতা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করা না হয়। এ দিকে রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেলের চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়ান ইয়ান রাখাইন তার ফেসবুক আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্ট প্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে। একইভাবে, কানাডা প্রবাসী প্রজ্ঞা তাপস চাকমা (ফেসবুক আইডি : চঞ ঈযধশসধ) সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করার মতো উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খাগড়াছড়ির ঘটনার জেরে কয়েক দিনের অবরোধ, মিছিল ও সহিংসতার পর খাগড়াছড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত শনিবার দুপুর থেকে সদর উপজেলা পরিষদ এলাকা, মহাজন পাড়া, নারিকেল বাগান, চেঙ্গী স্কোয়ার ও শহীদ কাদের সড়কে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় স্বনির্ভর ও নারিকেল বাগান এলাকায় বেশ কয়েকটি দোকানে হামলার ঘটনা ঘটে।

পরিস্থিতি অবনতির পর খাগড়াছড়ি পৌরসভা, সদর উপজেলা ও গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তা বলবৎ আছে। ৭ প্লাটুন বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি এপিবিএন মোতায়েন রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে খাগড়াছড়ি সদরে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। তার বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি করলে সেনাবাহিনী পরদিনই অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে (১৯) গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করলেও, ইউপিডিএফ শুরু থেকেই ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে মোড় নেয়ার চেষ্টা চালায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গত মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ১০টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলায় মারমা সম্প্রদায়ের একজন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে কয়েকজন দুর্বৃত্তের হাতে অপহরণের শিকার হয় বলে অভিযোগ উঠে। পরবর্তীতে ধর্ষণের শিকার স্কুলছাত্রীকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করলে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় জড়িত মূল আসামি শয়ন শীলকে পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে সেনাবাহিনীর সদর জোনের সহযোগিতায় পুলিশ দ্রুত গ্রেফতার করে। আদালতে হস্তান্তরের পর তার বিরুদ্ধে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। বাকি অপরাধীদের ধরতে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ইউপিডিএফের উসকানিতে তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ সমর্থিত সংগঠনগুলোর উদ্যোগে খাগড়াছড়ি সদর শাপলা চত্বরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়। একই দিন রাঙ্গামাটিতেও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের আড়ালে এই সংগঠনগুলো সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার প্রচারণা চালাতে থাকে। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফের ডাকা আধা বেলা হরতালে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। চারটি দূরপাল্লার বাসে হামলা, গ্লাস ভাঙচুর, রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ সৃষ্টি এবং একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। গুইমারা, মানিকছড়ি, রামগড় ও দীঘিনালায় সন্ত্রাসীরা টায়ার পুড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায় এবং হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ২৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ মাঠে ইউপিডিএফ সমর্থিত জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা মহাসমাবেশে অংশ নেয় প্রায় এক হাজারের বেশি লোক। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সমাবেশস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীর গাড়ির ওপর আকস্মিক হামলা চালানো হয়। এতে সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ভাঙচুর হয় এবং চার সেনাসদস্য আহত হন। অথচ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই পরিস্থিতি শান্ত রাখে।

এ দিকে গত শনিবার ইউপিডিএফ সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ ডেকে সাজেকে আটকে পড়ে হাজারো পর্যটককে জিম্মি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনী পর্যটকদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। সেদিন খাগড়াছড়ি সদর, মানিকছড়ি, গুইমারা, রামগড় ও দীঘিনালায় অবরোধ সৃষ্টি করে গাছ ফেলা ও টায়ার জ্বালিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ানো হয়। দুপুরে জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করলেও উভয়পক্ষ তা মানেনি। বিকেল নাগাদ বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, গতকাল নতুন করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মাটিরাঙ্গা-গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায়। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ইউপিডিএফ (প্রসীত) দলের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা-গুইমারা উপজেলা সংগঠক ঝিমিত চাকমার অধীনস্থ এলাকার গুইমারা রামেসু বাজারে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে এবং এতে অন্তত একজন পাহাড়ি নারী নিহত হয়েছেন। ঝিমিত চাকমা দলটির কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক রবি চন্দ্র চাকমার কাছে চাঁদা দাবি করেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া একই স্থানে সংঘর্ষে আরো অন্তত চারজন পাহাড়ি গুরুতর আহত হয়েছেন এবং বাজার এলাকাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে বলে ঝিমিত চাকমা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি ঝিমিত চাকমা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কার) দলকে গোলাগুলির ঘটনায় দায়ী বলেও মন্তব্য করেন।

রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড : নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ইউপিডিএফ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নারী সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত করা এবং পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি ভেঙে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়া। অতীতেও একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল ইউপিডিএফ। প্রতিবারই সেনাবাহিনীর ধৈর্য ও স্থানীয় প্রশাসনের বিচক্ষণতায় বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউপিডিএফ ও জেএসএসের বিভিন্ন শাখা ভেতরে ভেতরে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও তারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একযোগে অবস্থান নেয়। সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল প্রমাণ করার কৌশল নিচ্ছে।

বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করছে। কিন্তু ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলো সেই ঐক্য ভাঙার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের এই ষড়যন্ত্র রুখে দিতে স্থানীয় জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে।

সেনাবাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টা : বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনী দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করছে। উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাকার্যক্রমে সহায়তা দেয়া, দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দুর্যোগকালীন ত্রাণসহায়তায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জনে তারা জনগণের সেনাবাহিনী হিসেবে কাজ করছে। তাদের এই ধৈর্য, মানবিকতা ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মনে আস্থা তৈরি করছে, যা রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধৈর্যশীল পদক্ষেপই পাহাড়ে বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে হলে সাধারণ মানুষকে শান্তি-শৃঙ্খলার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। তাহলেই পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।