রিজার্ভ তদন্তে নতুন মোড়

দুই ভারতীয় নাগরিকসহ ২০ জনের তথ্য তলব

বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রায় এক দশক পরও রহস্যমুক্ত হয়নি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রায় এক দশক পরও রহস্যমুক্ত হয়নি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংস্থাটি সম্প্রতি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক ১৮ কর্মকর্তা এবং দুই ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ২০ জনের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

চিঠিতে অভিযুক্তদের পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, দায়িত্বকাল ও দায়িত্বের পরিধি এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ তালিকায় এমন সব ব্যক্তির নাম রয়েছে, যারা রিজার্ভ চুরির সময় সরাসরি দায়িত্বে ছিলেন অথবা নীতি শিথিলতার সুযোগে অর্থ লোপাটের পটভূমি তৈরি করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

তালিকায় কারা আছেন : বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো: মেজবাউল হক (সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন), আইসিটি বিভাগের দেবদুলাল রায়, কমন সার্ভিস-২ এর পরিচালক মো: তফাজ্জল হোসেন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ, আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মসিউজ্জামান খান (যার নাম দু’বার উল্লেখ আছে) এবং আইসিটি বিভাগের রাহাত উদ্দিন। এদের মধ্যে মাসুম বিল্লাহ ছাড়া বাকিরা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।

সাবেকদের মধ্যে রয়েছেন তিন গভর্নর ড. আতিউর রহমান (চুরির সময় দায়িত্বে), ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। এ ছাড়া আছেন সাত সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা রাজী হাসান, এস এম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ নাছের, আহমেদ জামাল ও মো: মাসুদ বিশ্বাস। আরো আছেন সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।

বিদেশী নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা : তালিকায় ভারতীয় নাগরিক নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানার নাম বিশেষভাবে আলোচিত। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির আগে তিনটি বিদেশী ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য সুইফট সংযোগে কাজ করেছিলেন। রাকেশ আস্তানা চুরির পর নিয়োগ পান ব্যাংকের সার্ভার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণের কাজে। অভিযোগ রয়েছে, দুজনকেই সার্ভারে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছিল, ফলে তারা দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত হয়ে পড়েন।

আইটি সিন্ডিকেট ও ঝুঁকি : বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। দক্ষ জনবলকে উপেক্ষা করে অনুগতদের নিয়োগ দেয়া হতো। সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল অনুমোদন ছাড়াই সুইফট সিস্টেমের সাথে রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) সফটওয়্যারের সংযোগ। এ সিদ্ধান্ত ব্যাংকের নিরাপত্তায় মারাত্মক ফাঁক তৈরি করে।

তৎকালীন কর্মকর্তা দেবদুলাল রায়, নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা এবং ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর নাম এই পরিকল্পনায় প্রধান হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন রাকেশ আস্তানা।

রহস্যজনক বৈঠক ও আলামত নষ্টের অভিযোগ : ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রাকেশ আস্তানাকে ব্যাংকের ২৯ তলায় দেবদুলাল রায়ের কক্ষে নিয়মিত বৈঠক করতে দেখা যায় যদিও তিনি তখন কোনো আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে ছিলেন না।

চুরির পর সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান গোপনে তাকে নিয়োগ দেন। অভিযোগ আছে, তিনি ও দেবদুলাল রায় এক মাসব্যাপী ব্যাংকের ভেতরে প্রমাণ নষ্টের কাজ করেছেন। গণমাধ্যমে আইটি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা এ অভিযোগ প্রকাশ করেন, কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে তিনি গুম হন, যা নতুন রহস্য তৈরি করে।

অমীমাংসিত প্রশ্ন

* কেন অনুমোদন ছাড়াই সুইফট-আরটিজিএস সংযোগ দেয়া হলো?

* কেন নিরাপত্তা ঝুঁকি উপেক্ষা করা হলো?

* কেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মামলার বাইরে থাকলেন?

* আলামত নষ্টের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শাস্তির মুখোমুখি হলেন না কেন?

* মূল হোতা কে- সে প্রশ্ন আজো অমীমাংসিত।

রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ : অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী অংশের আশ্রয়ে অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পান। দেবদুলাল রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানও স্বীকার করেছেন যে, তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে আলোচনা করেই রাকেশ আস্তানাকে নিয়োগ দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি কেবল একটি আর্থিক অপরাধ নয় এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, সাইবার নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবের সীমাবদ্ধতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। প্রমাণ আংশিক বা নষ্ট, মূল হোতা অজ্ঞাত, অভিযুক্ত অনেকে দায়মুক্ত।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুদকের নতুন তদন্তের ফলে কিছু সত্য বের হলেও যদি পরিকল্পনাকারী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সহযোগীদের আইনের আওতায় না আনা যায়, তবে এই ঘটনা শুধু কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়েই থাকবে না বরং বাংলাদেশের আর্থিক খাত ও প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতি আস্থা আরো দুর্বল করবে।